ঢাকের বাদ্যি: দুর্গা পূজার উৎসবের হৃদয়স্পর্শী সুর ও ইতিহাস
দুর্গা পূজার সময় ঢাকের তালে যেমন আনন্দ ছড়ায়, তেমনি ঢাকের সুরে এক ধরনের আবেগও জড়িয়ে থাকে।
দুর্গা পূজা শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে যে কয়েকটি জিনিস আমাদের মনে আসে, তার মধ্যে ঢাকের বাদ্যি অন্যতম। ঢাকের সুর ছাড়া দুর্গা পূজার আনন্দ যেন অসম্পূর্ণ। পঞ্চমী থেকে শুরু করে বিজয়া দশমী পর্যন্ত প্রতিটি দিনের পূজার আচার ও উৎসব ঢাকের তালে তালে এক অন্য রকম প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
ঢাকের সুর শুধুমাত্র একটি বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ নয়, এটি দুর্গা পূজার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। চলুন ঢাকের গুরুত্ব ও ইতিহাস সম্পর্কে বিশদে জানি।
ঢাকের তাৎপর্য
ঢাক হলো এক ধরনের বিশেষ বাদ্যযন্ত্র, যা প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে পূজা-পার্বণের সঙ্গে যুক্ত। দুর্গা পূজায় ঢাকের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে কারণ এর তালে পূজারত মনকে একাগ্র করে এবং উৎসবের আমেজকে বাড়িয়ে তোলে। ঢাকের শব্দ বাঙালির মনের গভীরে একটি আবেগ ও আনন্দের সুর তোলে। এটি দুর্গা পূজার আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গেই আবদ্ধ, বিশেষত সন্ধিপুজো এবং অন্যান্য বিশেষ মুহূর্তে। ঢাকের সুরের মধ্য দিয়ে ভক্তরা দেবী দুর্গার প্রতি ভক্তি নিবেদন করেন, যা পূজার এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়।
আরো পড়ুনঃ দুর্গা পূজার উপকরণ: দুর্গা পূজার প্রতিটি সামগ্রীর মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য
ঢাকের উৎসবের সাথে সংযোগ
ঢাকের শব্দ যখন শোনা যায়, তখন দুর্গা পূজার উৎসবের আনন্দ যেন বহুগুণে বেড়ে যায়। প্রতিটি পাড়ার মণ্ডপ, বাড়ির পূজা কিংবা বড় মণ্ডপে, ঢাকের বাদ্যি যেন দুর্গা পূজার সূচনা থেকে শুরু করে বিসর্জনের মুহূর্ত পর্যন্ত পূজার মেলবন্ধন তৈরি করে। বিশেষ করে সন্ধিপুজোর সময় ঢাকের বিশেষ তালে দেবী দুর্গার মূর্তিতে প্রাণসঞ্চার হয় বলে মনে করা হয়। ঢাকের বাদ্যি শুধু একটি সংগীত নয়, এটি দেবীর আগমনের সংকেত বহন করে।
ঢাকের ইতিহাস
ঢাকের ইতিহাস প্রাচীন ভারতবর্ষের সঙ্গে জড়িত। ধারণা করা হয়, ঢাকের উৎপত্তি মূলত মুঘল আমলে। তখন থেকে এটি বাংলার পূজা-পার্বণ, বিশেষত দুর্গা পূজার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। ঢাকিরা বিশেষত মজুর সম্প্রদায়ের লোকজন ছিলেন, যারা মুঘল আমল থেকে এ বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢাক বাঙালির ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের অংশ হয়ে ওঠে। ঢাকিরা রাজবাড়ি এবং জমিদারবাড়ির পূজায় বাদ্য বাজাতেন, এবং ক্রমে এটি জনসাধারণের পূজার অনুষ্ঠানেও প্রচলিত হয়ে পড়ে।
আরো পড়ুনঃ দুর্গা পূজার ভোগ: পঞ্চব্যঞ্জনের ঐতিহ্যবাহী রান্নার মাহাত্ম্য
ঢাকিরা এবং তাদের জীবিকা
ঢাকিরা দুর্গা পূজার সময় বিশেষভাবে সম্মানিত হয়। তারা সারা বছর বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও, দুর্গা পূজার সময় ঢাক বাজানো তাদের একটি মূল পেশা হয়ে ওঠে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, যেমন বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর থেকে ঢাকিরা কলকাতা এবং শহরাঞ্চলে এসে দুর্গা পূজার সময় তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজায়। ঢাকিরা তাদের ঢাককে নিজের হাতে যত্ন করে সাজায়, যাতে পূজার সময় প্রতিটি তাল নিখুঁতভাবে বাজানো যায়। ঢাকিরা পূজা শেষে সিঁদুর খেলায় অংশগ্রহণ করে, যা দেবী দুর্গার বিদায়কে আরও আনন্দমুখর করে তোলে।
ঢাকের বাদ্যি: আনন্দ ও আবেগের মিশ্রণ
দুর্গা পূজার সময় ঢাকের তালে যেমন আনন্দ ছড়ায়, তেমনি ঢাকের সুরে এক ধরনের আবেগও জড়িয়ে থাকে। ঢাকের শব্দ বাঙালির মনকে দুর্গা পূজার আবহে পূর্ণ করে তোলে। বিজয়া দশমীর দিন, ঢাকের করুণ সুর যখন বাজে, তখন দেবী দুর্গার বিদায়ের মুহূর্ত এসে যায়। ঢাকের এই সুর যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, দেবী আবারও ফিরে আসবেন পরের বছর, এবং ঢাকের তালে আবারও পূজা হবে প্রাণবন্ত।
ঢাকের বাদ্যি দুর্গা পূজার আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এর ঐতিহ্য এবং তাৎপর্য শুধু উৎসবের আনন্দে নয়, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি ভক্তির প্রতিফলনেও বিদ্যমান। ঢাকের সুর পূজার পরিবেশকে পবিত্র ও উজ্জ্বল করে তোলে, যা দুর্গা পূজাকে একটি সম্পূর্ণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতায় পরিণত করে।