পঞ্চমী থেকে বিজয়া: দুর্গা পূজার পাঁচ দিনের মাঙ্গলিক মাহাত্ম্য
দুর্গা পূজার পাঁচ দিন শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয়; এটি হল আনন্দ, উচ্ছ্বাস, এবং ঐতিহ্যের উৎসব।
দুর্গা পূজা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, যার মধ্যে মিশে থাকে ধর্ম, সংস্কৃতি, এবং ঐতিহ্যের সমাহার। দেবী দুর্গার এই আরাধনা কেবল একটি পূজা নয়; এটি জীবনের পবিত্রতা, শুভশক্তির আরাধনা, এবং আনন্দের প্রতীক। দুর্গা পূজার পাঁচটি দিন, অর্থাৎ পঞ্চমী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত প্রতিটি দিনই ভিন্ন ভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস, এবং মাহাত্ম্যে পরিপূর্ণ। আসুন জেনে নিই, এই পাঁচ দিনের বিশেষ তাৎপর্য।
১. পঞ্চমী: দেবীর বোধনের সূচনা
দুর্গা পূজার শুভ সূচনা হয় পঞ্চমীর দিনে। এই দিনে মর্ত্যে দেবীর আগমনের বার্তা ঘোষিত হয়। বোধনের আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবীকে মর্ত্যে আহ্বান করা হয়। পুরাণ অনুযায়ী, দেবী দুর্গা প্রতি বছর এই দিনে সন্তানদের সাথে কৈলাস পর্বত থেকে পৃথিবীতে আসেন। পঞ্চমীর দিন প্রতিমার সামনে মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে দেবীর বোধন সম্পন্ন করা হয়, যা দেবীকে মর্ত্যে উপস্থিত করার আচার হিসেবে ধরা হয়। এই দিন থেকেই পূজামণ্ডপগুলোতে সুর ও আলোয় সাজসজ্জার প্রস্তুতি শুরু হয়।
আরো দেখুনঃ ২০২৪ সালের দুর্গাপূজার সময়সূচি: বিস্তারিত তিথি ও পূজার রীতি
২. ষষ্ঠী: দেবীর বোধন, অধিবাস ও আমন্ত্রণ
মহাষষ্ঠীর দিনই দুর্গা পূজার মূল পর্বের সূচনা হয়। এই দিনে দেবী দুর্গার বোধন, অধিবাস, এবং আমন্ত্রণের আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী, এই দিন দেবী দুর্গা তাঁর সন্তানদের নিয়ে মর্ত্যে পদার্পণ করেন। মহাষষ্ঠীর দিনে নবপত্রিকা স্নান করানো হয় এবং তারপর মণ্ডপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। নবপত্রিকা আসলে দেবীর এক প্রতীকী রূপ, যেখানে নয়টি উদ্ভিদকে দেবীর শক্তির প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় ঢাকের বাদ্যিতে দেবী বন্দনার আচার শুরু হয়, যা পুরো পরিবেশকে মাতিয়ে তোলে।
৩. সপ্তমী: নবপত্রিকা প্রবেশ ও দেবী বন্দনা
মহাসপ্তমী হল দুর্গা পূজার অন্যতম প্রধান দিন। এই দিন সকালে নবপত্রিকাকে পবিত্র জল দিয়ে স্নান করিয়ে দেবীর আসনে স্থাপন করা হয়। নবপত্রিকা আসলে দেবীর নয়টি শক্তির প্রতীক, যা কলাবউ নামে পরিচিত। এরপর প্রতিমা পূজার আচার শুরু হয়। সপ্তমীর দিন থেকেই দেবীর পূজা ও অঞ্জলি দেওয়ার আচার শুরু হয়, যা এই পাঁচ দিনের পূজার অন্যতম আকর্ষণ।
সপ্তমীর দিন ভক্তরা দেবীর কাছে নিজেদের মনোবাসনা জানিয়ে অঞ্জলি প্রদান করেন এবং দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। এই দিন থেকেই মণ্ডপগুলোতে ভক্তদের ভিড় জমতে থাকে এবং ঢাক, কাঁসর, শঙ্খধ্বনির মধুর সুরে দেবীর বন্দনা হয়।
৪. অষ্টমী: দেবীর মহা অর্চনা ও সন্ধিপূজা
মহাষ্টমী দুর্গা পূজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনেই দেবী দুর্গার মহাশক্তির পূজা করা হয়। অষ্টমীর দিন সকালে মহাষ্টমী পুজো ও কুমারী পুজো সম্পন্ন হয়। কুমারী পূজা হল একটি বিশেষ আচার, যেখানে কুমারী মেয়েদের দেবীর রূপে পূজা করা হয়। এটি নারীর শক্তির আরাধনার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।
অষ্টমীর দিন সন্ধিপূজা সম্পন্ন হয়, যা নবমী তিথি শুরুর মুহূর্তে করা হয়। এই সন্ধিপূজা মহাষ্টমী ও মহানবমীর সংযোগস্থলে সম্পন্ন হয় বলে এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এটি মূলত দেবীর চণ্ডী রূপের আরাধনা, যেখানে অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য দেবীর মাহাত্ম্য বন্দনা করা হয়। অষ্টমীর সন্ধিপূজার সময় মণ্ডপে ধুনুচি নাচের আয়োজন হয়, যা পূজার অন্যতম আকর্ষণ।
আরো দেখুনঃ শারদীয় দুর্গাপূজার ইতিহাস ও গুরুত্ব: বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের গল্প
৫. নবমী: দেবীর মহিষাসুর বধের আচার
মহানবমী দেবীর মহাপূজার শেষ দিন। এই দিন দেবী দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী রূপের পূজা করা হয়। পুরাণ অনুসারে, এই দিনেই দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। মহানবমীর পূজায় ভক্তরা দেবীর কাছে শক্তি, সাহস এবং শুভশক্তির আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।
নবমীর দিনে ভোগ নিবেদন করা হয়, যা দেবীকে উৎসর্গ করা হয়। এরপর সেই প্রসাদ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। নবমীর দিন রাতে মণ্ডপে ঢাক, কাঁসর, ও শঙ্খধ্বনির মধ্যে দিয়ে দেবীকে বিদায় জানানোর প্রস্তুতি শুরু হয়।
৬. দশমী: বিজয়া ও সিঁদুর খেলা
বিজয়া দশমী দুর্গা পূজার শেষ দিন। এই দিন দেবী দুর্গাকে বিসর্জনের মাধ্যমে মর্ত্য থেকে কৈলাসে বিদায় দেওয়া হয়। ভক্তরা দেবীকে সিঁদুর, মিষ্টি, এবং পানীয় অর্পণ করে তাঁর কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।
বিজয়া দশমীর অন্যতম আকর্ষণ হল সিঁদুর খেলা। দেবীর মূর্তিতে সিঁদুর পরানোর পর পূজারিণীরা একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে দেন এবং মিষ্টি বিতরণ করেন। এটি নারীদের আনন্দের একটি বিশেষ পর্ব, যা সকলের মধ্যে সম্প্রীতির বার্তা বহন করে।
বিসর্জনের সময় ঢাকের বাদ্যি ও শঙ্খধ্বনির মধ্যে দিয়ে ভক্তরা দেবীকে বিদায় জানান এবং পরবর্তী বছরের পূজার আশায় অপেক্ষায় থাকেন। বিজয়া দশমীর দিন বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়দের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করে বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়।
আরো দেখুনঃ দুর্গা পূজার আচার-অনুষ্ঠানে নারীদের ভূমিকা
দুর্গা পূজার পাঁচ দিন শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয়; এটি হল আনন্দ, উচ্ছ্বাস, এবং ঐতিহ্যের উৎসব। পঞ্চমী থেকে বিজয়া পর্যন্ত প্রতিটি দিনের নিজস্ব একটি বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। এই পাঁচটি দিন বাঙালির জীবনকে সমৃদ্ধ করে, শক্তি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
দুর্গা পূজা তাই কেবল দেবী বন্দনার উৎসব নয়; এটি একটি মহামিলন, যা প্রত্যেককে একত্রিত করে মঙ্গলময় জীবনের পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।