বৌদ্ধ প্রধান মিয়ানমারে হিন্দু ধর্ম যেভাবে এখনো টিকে আছে
মিয়ানমারে হিন্দু ধর্ম! মিয়ানমার দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। মিয়ানমারের প্রাচীন নাম ব্রহ্মদেশ। হিন্দু দেবতা ব্রহ্মার নাম থেকেই মিয়ানমারের প্রাচীন নামের উৎপত্তি। এরপর ব্রিটিশ শাসনামলে দেশটি বার্মা নামে পরিচিতি পায়।
মিয়ানমারের মোট আয়তন ৬৭৬,৫৫২ বর্গকিলোমিটার। মিয়ানমারের পশ্চিমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ এবং ভারতের মিজোরাম, উত্তর-পশ্চিমে ভারতের আসাম, নাগাল্যান্ড ও মণিপুর অবস্থিত।
২০১৭ সালের শুমারি অনুযায়ী মিয়ানমারের জনসংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৩৬ লক্ষ। দেশটির জনসংখ্যার শতকরা ৮৮ ভাগ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। এছাড়া মিয়ানমারে ইসলাম, হিন্দু ও খ্রীস্টান ধর্মানুসারীরাও বসবাস করে। একসময় সনাতন হিন্দু ধর্ম মিয়ানমারের অন্যতম প্রধান ধর্ম হলেও বর্তমানে মিয়ানমারে হিন্দু জনসংখ্যা অনেকটাই কম। পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য মতে, ২০১০ সালে মিয়ানমারে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৮ লক্ষ ২০ হাজার।
আরো পড়ুনঃ দক্ষিণ আমেরিকার দেশ সুরিনামে হিন্দু ধর্ম যেভাবে অন্যতম প্রধান ধর্ম হয়ে উঠেছে!
খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্ম এবং মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি সনাতন ধর্মের বিভিন্ন মতবাদ মিয়ানমারে প্রচলিত ছিল। দেশটির প্রাচীন নাম ব্রহ্মদেশ থেকেই অনুমান করা যায় হিন্দুধর্মের সাথে মিয়ানমারের সংযোগ বেশ পুরনো।
ভারত এবং মিয়ানমারের মধ্যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই যোগাযোগ ছিল। ভারতীয়দের মাধ্যমেই মূলত মিয়ানমারে হিন্দু ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল। ঔপনিবেশিক শাসন পূর্ব সময়কালে হিন্দু ধর্ম বার্মিজ রাজাদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, যার প্রমাণ পাওয়া যায় মিয়ানমারের প্রাচীন শহর বাগানের বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শন থেকে। এছাড়া বার্মিজ ভাষার প্রচুর শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।
মিয়ানমারের হিন্দু ধর্মের অনেকটা বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা প্রভাবান্বিত। অনেক হিন্দু মন্দিরে হিন্দু দেবতার পাশাপাশি গৌতম বুদ্ধের মূর্তিও দেখা যায়।
মিয়ানমারে বসবাসরত মনিপুরী জাতিগোষ্ঠীর অধিকাংশ সনাতন হিন্দু ধর্ম অনুসরণ করে। ১৮১৯ থেকে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত মনিপুরী-বার্মিজ যুদ্ধের সময় বহু মনিপুরীকে জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে মিয়ানমারে নিয়ে আসা হয়।
আরো পড়ুনঃ সংযুক্ত আরব আমিরাতের হিন্দুরা আসলে কেমন আছে?
মিয়ানমারে বসবাসরত নেপালী ভাষী গোর্খারাও হিন্দু ধর্ম অনুসরণ করে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে এ সকল গোর্খারা একসময় মিয়ানমারে এসেছিল। গোর্খাদের দ্বারা সমগ্র মিয়ানমার জুড়ে কমপক্ষে ২৫০টি হিন্দু মন্দির নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া বেশ কিছু সংখ্যক বাঙালি, তামিল এবং রোহিঙ্গা হিন্দু মিয়ানমারে হিন্দু ধর্ম পালন করে।
মিয়ানমারের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে হিন্দু ধর্মের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের একটি বার্মিজ সংস্করণ রয়েছে, যার নাম ‘যম জাতদাও”। আন অফিসিয়ালি এটি মিয়ানমারের জাতীয় মহাকাব্য। এই মহাকাব্যটির কাহিনী সরাসরি রামায়ণ থেকে নেয়া হয়েছে।
এছাড়া মিয়ানমারের বৌদ্ধরা স্বরস্বতী, শিব ও বিষ্ণুর উপাসনা করে। বার্মিজ ভাষায় সরস্বতীকে ডাকা হয় থায়াতডি নামে, শিবকে ডাকা হয় পরমিজ্ব নামে এবং বিষ্ণুকে ডাকা হয় উইথানো নামে।
বর্তমানে মিয়ানমারের হিন্দুদের বেশীর ভাগ ইয়াঙ্গুন এবং মান্দালয় শহরে বসবাস করে। এই দুটি শহরে প্রচুর হিন্দু মন্দির রয়েছে। এছাড়া সমগ্র মিয়ানমার জুড়েই অসংখ্য হিন্দু মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে বাগান শহরে ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত নাথলাউং মন্দিরটি খ্রিস্টীয় ১১ শতকে নির্মিত হয়েছিল।
মায়ানমারের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মন্দির হলো, নাথলাউং মন্দির, শ্রী কালী মন্দির, ভদ্র কালী আম্মান মন্দির, শ্রীকুমার কার্তিকায় মন্দির, শ্রী মুরুগান মন্দির প্রভৃতি।
আরো পড়ুনঃ মুসলিম দেশ মালয়েশিয়ায় হিন্দু ধর্মের হাজার বছরের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস
মিয়ানমারের হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে দিপাবলী, হোলি। দিপাবলীতে মিয়ানমারে পাবলিক হলি ডে। মিয়ানমার হিন্দু সেন্ট্রাল কাউন্সিল এবং সনাতম ধর্ম স্বয়ংসেবক সংঘ মিয়ানমারে হিন্দুদের দুটি বড় সংগঠন।