দোল যাত্রার ইতিহাস! দোল যাত্রার প্রচলন হলো কীভাবে?
দোল পূর্ণিমা বা দোল যাত্রা সনাতন হিন্দু ধর্মানুসারীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। বাংলা ও উড়িষ্যা ছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে দোল উৎসব মহাসমারোহে পালিত হয়। ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানে দোল যাত্রা ‘হোলি’ নামে পরিচিত। দোল উৎসবের অপর নাম বসন্তোৎসব। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
দোল বা হোলি একই রকম মনে হলেও এ দুটি মূলত আলাদা অনুষ্ঠান। দোল ও হোলি কখনোই একই দিনে পড়ে না। দোল যাত্রা বা দোল উৎসব একান্তই বাঙালিদের, আর হোলি অবাঙালিদের উৎসব। বাঙালি সমাজে দোলযাত্রাকে বসন্তের আগমনী বার্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আরো পড়ুনঃ দোলযাত্রা বা হোলিতে রাশি অনুযায়ী কোন রঙ আপনার সৌভাগ্য ফিরিয়ে আনবে জানেন কি?
২০২০ সালের দোল পূর্ণিমা বা দোল যাত্রা পালিত হবে আগামী ৯ মার্চ ২০২০, সোমবার। সনাতন পন্ডিতের আজকের আয়োজন থেকে আমরা জানবো, দোল যাত্রার ইতিহাস ও কীভাবে দোলযাত্রার প্রচলন হয়েছিল।
বৈষ্ণবীয় বিশ্বাস মতে, দোল পূর্ণিমার দিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবীর ও গুলাল সহকারে শ্রীরাধা ও অন্যান্য গোপীদের সাথে রঙ খেলায় মেতেছিলেন। সেখান থেকেই দোল যাত্রার উৎপত্তি। ১৪৮৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দোল পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই এই তিথিকে গৌর পূর্ণিমাও বলা হয়।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর সখী গোপীরাই দোলযাত্রা উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। ভগবানের এই লীলা বিলাস কবে শুরু হয়েছিল, তা জানা না গেলেও বিভিন্ন আখ্যান বা পদে সেই মধুর কাহিনী বর্ণিত আছে।
হিন্দু পুরাণে প্রায় দুই হাজার বছর আগে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কর্তৃক গোকুলে হোলি খেলা প্রচলনের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ইতিহাসে একাধিক ইন্দ্রদ্যুম্নের নাম পাওয়া যায়। ফলে এই ইন্দ্রদ্যুম্ন কে ছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায়না।
জৈমিনির ‘পূর্ব মীমাংসা সূত্র’তে দোল যাত্রার কথা উল্লেখ আছে। এছাড়া ‘মালতি মালব’ নামক নাটকেও বসন্ত উৎসবের কথা আছে। খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দীতে সম্রাট হর্ষবর্ধন কর্তৃক লিখিত রত্নাবলী নাটকে হোলি খেলার বর্ণনা রয়েছে।
আরো পড়ুনঃ ইতালি থেকে মেক্সিকো, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রামায়ণ ও রামের অস্তিত্ব
মহাকবি কালীদাসে ‘ঋতুসংহার’ কাব্যে বসন্ত বর্ণনায় দেখা যায়, যুবতী ও রমণীরা কৃষ্ণ চন্দন, কুসুম রস এবং কুমকুম মিশ্রিত রঙে নিজেদের রাঙ্গাচ্ছে। দক্ষিণ ভারতের বিজয়নগরের হাম্পিতে একটি মন্দিরের দেয়ালে এক রাজকুমার ও রাজকুমারীর হোলিখেলার দৃশ্য খোদাই করা আছে।
কৃষ্ণের বাল্যলীলা ক্ষেত্র বৃন্দাবন-মথুরাতে হোলি চলে ১৬ দিন ব্যাপী। প্রাচীন ভারতে এই উৎসবকে হোলিকা উৎসব নামেও অভিহিত করা হয়েছে। ভবিষ্য পুরাণ, বেদ ও নারদ পুরাণে হোলিকা উৎসবের বর্ণনা পাওয়া গেছে। বিন্ধ্য পার্বত্য অঞ্চলে প্রাপ্ত লিপি থেকে অনুমান করা হয় খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দেও হোলি উৎসবের প্রচলন ছিল।
বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের কথা তো আমরা সবাই জানি। প্রহ্লাদের পিতা দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু পুত্রের এই বিষ্ণুভক্তি পছন্দ করতেন না। হিরণ্যকশিপু বিভিন্ন উপায়ে পুত্র প্রহ্লাদকে হত্যা চেষ্টা করেন। বিভিন্ন উপায়ে ব্যর্থ হয়ে তিনি তাঁর বোন হোলিকা নির্দেশ দেন প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করতে। হোলিকার ওপর দৈব আশীর্বাদ ছিল, অগ্নি কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারবেনা। কিন্তু প্রহ্লাদকে নিয়ে অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করা মাত্র হোলিকা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো, কিন্তু ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অক্ষত রইলেন। হোলিকার এই ঘটনাকে উদযাপনের জন্য হোলি উৎসবের সূচনা বলে ধারণা করা হয়। আবার ধারণা করা হয়, বাল্যকালে শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক পুতনা রাক্ষসী বধকে স্মরণ করে হোলি উৎসবের জন্ম।
আরো পড়ুনঃ বৃন্দাবন ধামের অজানা ইতিহাস ও ভ্রমণ গাইড
বাংলা অঞ্চলে দোল উৎসবের সূচনা হয় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু দ্বারা। ভারতের বাইরে বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো, সুরিনাম, ফিজি, গায়ানা, মালয়েশিয়ায় হোলি খেলার প্রচলন রয়েছে। গায়ানায় হোলিক ফাগুয়া বলা হয়।
আধুনিককালে বাংলাতে দোল যাত্রার সূচনা করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯২০ সালে রবি ঠাকুর শান্তি নিকেতনে দোল যাত্রা উৎসবের সূচনা করেন। এতোদিন দোল পূর্ণিমার দিন শান্তি নিকেতনে বসন্ত উৎসব পালিত হতো। তবে দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য ভেঙ্গে ২০২০ সাল থেকে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ দোল যাত্রার আগেই বসন্ত উৎসব পালন করেছেন।