শ্রীকৃষ্ণের রাক্ষস বধ: জেনে নিন কতজন দানব ও রাক্ষসকে বধ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ
শ্রীকৃষ্ণের রাক্ষস বধ
দুষ্টের বিনাশ করে এই জগত সংসারে শান্তি আনতে ভগবান যুগে যুগে বিভিন্ন অবতারে আবির্ভূত হন। বিভিন্ন পুরাণ ও মহাভারতের কাহিনী গভীরভাবে পড়লে দেখা যায়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অসংখ্যবার দুর্গতকে রক্ষা করেছিলেন। এই গ্রন্থগুলোতে শ্রীকৃষ্ণকে বারবার দানব সংহারী হিসেবে আবির্ভূত হতে দেখা গেছে। এই দানবেরা কোন না কোন অসদ গুণের প্রতীক।
আমাদের আজকের আয়োজন থেকে জেনে নেব, শ্রীকৃষ্ণ ঠিক কতজন দানবকে বধ করেছিলেন এবং সেই দানবদের পরিচয়। চলুন তবে জেনে নিই শ্রীকৃষ্ণের রাক্ষস বধ কাহিনী।
১. পুতনা বধ – এক মাস বয়সে পুতনা রাক্ষসীকে বধ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। অত্যাচারী রাজা কংস আপন ভাগ্নে শ্রীকৃষ্ণকে হত্যার জন্য পুতনা রাক্ষসীকে পাঠিয়েছিলেন। পুতনা মায়াবলে সুন্দরী স্ত্রী মূর্তি ধারণ করে নন্দের গৃহে আসে। সেখানে সবার অলক্ষে সে শিশু কৃষ্ণকে মাতৃস্নেহে বিষমাখা স্তন পান করিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। শ্রীকৃষ্ণ পুতনার স্তন পানকালে তার জীবনীশক্তি শোষণ করে তাকে বধ করেন। মৃত্যুকালে পুতনা দানবীর রূপ ধারণ করে চিৎকার করতে করতে বিশাল জায়গা জুড়ে পতিত হয়। পুতনা রাক্ষসী মূলত ছদ্ম গুরুর প্রতীক।
২. শকটাসুর বধ — শ্রীকৃষ্ণের বয়স তখন মাত্র তিন মাস। মা যশোদা তাঁকে উঠোনে একটি খাটে শুইয়ে যমুনায় স্নান করতে গিয়েছিলেন। স্নান শেষে ফিরে এসে দেখেন উঠোনে ভাঙা খাট, কৃষ্ণ সেখানে নেই। হতবিহবল যশোদা ঘরে ঢুকে দেখেন কৃষ্ণ বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছেন।
আরো পড়ুনঃ কলিযুগের শেষেই কি সর্বনাশ! কী অপেক্ষা করছে মর্ত্যবাসীর জন্য?
যখন যশোদা স্নান করতে গিয়েছিলেন তখন কৃষ্ণকে হত্যার উদ্দেশ্যে কংস শকটাসুর নামক এক রাক্ষসকে পাঠান। ঘুমন্ত শিশু কৃষ্ণকে শকটাসুর হত্যা করতে উদ্ধত হলে ছোট্ট কৃষ্ণ ওই বিশাল রাক্ষসকে আকাশে উঠিয়ে নেন। অতঃপর মাটিতে ছুড়ে ফেলে হত্যা করেন।
৩. তৃণাবর্ত বধ – শ্রীকৃষ্ণের বয়স যখন মাত্র ১ বছর তখন তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কংস তৃণাবর্ত নামক এক অনুচরকে পাঠান। তৃণাবর্ত মথুরায় এসে ঘূর্ণিবায়ু সৃষ্টি করে শ্রীকৃষ্ণকে আকাশে উঠিয়ে ফেলে। এ সময় শ্রীকৃষ্ণ নিজের শরীরকে এতোটা বৃদ্ধি করেন যে, তৃণাবর্ত কৃষ্ণকে বহন করতে অসমর্থ হয়। একই সময় কৃষ্ণ তৃণাবর্তের গলা টিপে ধরলে সে আকাশ থেকে পাথরে পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। বাতাসের ঘুর্ণির রূপধারী এই দানব পার্থিব অহংকারের প্রতীক।
৪. বৎসাসুর বধ – একদিন বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ যমুনা নদীর তীরে গোপ বালকদের সাথে বৎস অর্থাৎ গরু চরাচ্ছিলেন। সেই গরুর পালের মধ্যে একটি দৈত্য গরুর রূপ ধরে লুকিয়ে ছিল। বলরাম বিষয়টি আঁচ করে কৃষ্ণক দেখালেন। কৃষ্ণ না বোঝার ভান করে ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। অতঃপর বৎসাসুরের পিছনের দুটি পা ও লেজ একত্রে ধরে চক্রাকারে ঘুরাতে শুরু করলেন। বৎসাসুরের প্রাণ না যাওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁকে ঘুরালেন। পরে মৃতপ্রায় বৎসাসুরকে কপিথ গাছের ওপর নিক্ষেপ করলেন। বৎসাসুরের বিশাল দেহের ভারে ঐ বৃক্ষ ভেঙে পড়ল এবং বৎসাসুরের দেহ ভূমিতে পতিত হল।
আরো পড়ুনঃ ভারতের এই দুর্গা মন্দিরে পুরুষ ভক্তদের নারীবেশে পুজো দিতে হয়
৫. বকাসুর বধ – একদিন বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ অন্যান্য গোপবালকদের সাথে গরুকে জল খাওয়ানোর জন্য একটি জলাশয়ের নিকটে গেলেন। গরুদের জলপান করিয়ে তারা নিজেরাও জলপান করলেন। তখন গোপ বালকগণ একটু দূরেই একটি প্রকাণ্ড ও তীক্ষ্ম ঠোটের পাখি দেখতে পেল। অদ্ভুত এই পাখি দেখে গোপবালকেরা ভয় পেয়ে গেল। আসলে এটি কোন পাখি নয়। এটি ছিল পাখি রূপধারী অসুর যার নাম বকাসুর।
বকাসুর কৃষ্ণকে দেখা মাত্রই দ্রুতবেগে তাকে গিলে ফেলল। গোপবালকগণ এই দৃশ্য দেখে অচেতন হয়ে গেল। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বকাসুরের মুখের মধ্যে ক্রমাগত আঘাত করতে লাগলেন। আঘাত সইতে না পেরে বকাসুর কৃষ্ণকে মুখ থেকে ফেলে দিল। তারপর সুস্থ কৃষ্ণকে দেখে ঠোট দিয়ে পুণরায় আক্রমণ করলো। কৃষ্ণ দুই হাতে বকাসুরের দুই ঠোট চেপে ধরে তাকে হত্যা করলেন।
৬. অঘাসুর বধ – একদিন শ্রীকৃষ্ণ বনভোজনের ইচ্ছা প্রকাশ করে অন্যান্য গোপবালকদের সাথে গরুসহ বনে গমন করলেন। গরু চরাতে চরাতে সবাই নানারকম খেলাধুলা করতে লাগলো। সেই সময় অঘাসুর নামে এক মহাসুর সেখানে উপস্থিত হলো। অঘাসুর পুতনা ও বকাসুরের ছোট ভাই। কৃষ্ণকে দেখে অঘাসুর ভাবলো, এই ছেলেই আমার বোন ও ভাইকে হত্যা করেছে। যে করেই হোক আজ আমি কৃষ্ণকে বধ করবো।
আরো পড়ুনঃ হিন্দু ব্যতীত শুধু শিখরাই কেন পুরীর জগন্নাথ মন্দির প্রবেশ করতে পারে?
যেমন ভাবনা তেমন কাজ! অঘাসুর নিজেকে বিশাল অজগর সাপে পরিণত করে পর্বতের গুহাসদৃশ মুখ প্রসারিত করে অপেক্ষা করতে লাগলো। সর্পরূপী অঘাসুরকে দেখে গোপবালকগণ ভয়ে পেয়ে গেলো। তবে অন্য বালকেরা আশ্বাস দিয়ে বললো, এটি অজগর সাপের মতো দেখতে একটি প্রাকৃতিক গুহা। চলো ভেতরে যাই। আমাদের রক্ষা করার জন্য কৃষ্ণ রয়েছে। সব বালক অঘাসুরের মুখ গহবরে প্রবেশ করলেও অঘাসুর তাদের গিলে ফেললনা। কারণ সে কৃষ্ণের জন্য অপেক্ষা করছে।
বালক কৃষ্ণ সব বুঝেও সঙ্গীদের রক্ষা করার জন্য অঘাসুরের মুখ গহবরে প্রবেশ করলেন। তারপর নিজের দেহকে প্রসারিত করে অঘাসুরের মুখের সকল পথ রুদ্ধ করে দিলেন। ফলে নিঃশ্বাস ফেলতে না পেরে অঘাসুরের চক্ষুদ্বয় বাইরে বেরিয়ে এসে, সেখানেই মৃত্যুবরণ করে।
৭. কেশী বধ – শ্রী কৃষ্ণকে হত্যা করার জন্য কংস তাঁর দানব অনুচর কেশীকে প্রেরণ করেন। কেশী ঘোড়ার রূপ ধরে গোপদের উপর অত্যাচার শুরু করলে- শ্রীকৃষ্ণ এর প্রতিকার করার জন্য কেশীর মুখোমুখি হন। কেশী শ্রীকৃষ্ণকে গ্রাস করতে উদ্যত হলে- শ্রী কৃষ্ণ তাঁর বিশাল বাহু কেশীর মুখের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।
৮. কংস বধ – শ্রীকৃষ্ণ বধ করার অজস্র কৌশল ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষুব্ধ কংস, কৃষ্ণ ও বলরামকে এক মল্লযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। কংসের নির্দেশে মথুরা থেকে রথ সাজিয়ে বৃন্দাবনে এলেন কংসের বিশ্বস্ত দূত অক্রুর। এই রথেই কৃষ্ণ ও বলরামকে মথুরায় নিয়ে যাওয়া হয়। মল্লযুদ্ধে কৃষ্ণের হাতে কংসের শক্তিশালী মল্লযোদ্ধারা নিহত হয়। এতে ক্রুব্ধ হয়ে কংস দুই ভাই বলরাম ও কৃষ্ণকে নির্বাসনে পাঠানোর নির্দেশ দেন। একইসাথে তিনি নন্দরাজকে বন্দী এবং উগ্রসেন ও বসুদেবকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। কংসের এই আদেশ শোনা মাত্র শ্রীকৃষ্ণ কংসকে আক্রমণ করেন এবং সিংহাসন থেকে ছুড়ে মেরে হত্যা করেন। কংসের আট ভাই এতে বাধা দিলে বলরাম তাদের হত্যা করেন। পরে কৃষ্ণ মাতামহ উগ্রসেনকে সিংহাসনে বসিয়ে মথুরায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
৯. কালীয় দমন – একদিন কৃষ্ণ তার সখাদের সাথে যমুনাপুলিনে গোচারণ করছিলেন। কয়েকজন সখা ও কয়েকটি গরু যমুনার জল পান করে মৃত্যুবরণ করলো। কালীয় নামক এক বিষধর সাপের বিষে যমুনার জলের এই অবস্থা। এ ঘটনা দেখে কৃষ্ণ একটি কদম গাছে চড়ে যমুনার জলে ঝাঁপ দিলেন এবং সেই জলে প্রবল আলোড়ন তৈরি করলেন। তখন রাগে উন্মত্ত কালীয় নাগ শ্রীকৃষ্ণকে দংশন করতে নিজের বিশাল দেহ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের শরীরকে বেষ্টন করলো।
এদিকে কৃষ্ণ সাপের বেষ্টন থেকে নিজেকে মুক্ত করে স্কন্ধবেশ নত করিয়ে কালীয়ের মাথার ফণার উপর চড়ে নৃত্য করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণের চরণাঘাত সইতে না পেরে কালীয়ের মুখ দিয়ে রক্ত উঠল। চোখের ফলকে কালীয়ের শত শত মুখ দমিত হলো।
আরো পড়ুনঃ পৃথিবীর একমাত্র মন্দির যেখানে হনুমানজি পূজিত হন স্ত্রী বেশে
আঘাত সইতে না পেরে কালীয় নিজের ভুল স্বীকার করে শ্রীকৃষ্ণের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলো। শ্রীকৃষ্ণ কালীয়কে ক্ষমাপূর্বক নির্দেশ দিলেন, “এখন থেকে তুমি তোমার পূর্ব বসতি রমণক দ্বীপে বাস করো। তোমার মস্তকে আমার পদচিহ্ন আছে। গরুড় আর তোমার প্রতি হিংসা প্রদর্শন করবেনা।
এভাবে যমুনার জল বিষমুক্ত হয়ে পবিত্র হলো।