ভারতীয় স্থাপত্যরীতির এক চরম বিস্ময় মধেরা সূর্য মন্দির
মন্দিরের দেশ ভারতের আরেকটি বিষ্ময়কর মন্দির হলো মধেরা সূর্য মন্দির। গুজরাতের সাবেক রাজধানী আহমেদাবাদ থেকে ১০২ কিমি দূরে পুষ্পবতী নদীর তীরে মধেরা সূর্য মন্দির অবস্থিত। সোলাঙ্কী রাজত্বকালে ১০২৬ সালে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটি বর্তমানে কোন প্রকার উপাসনার কাজে ব্যবহৃত হয়না। বর্তমানে এটি ভারতের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীন আছে।
ব্রহ্ম পুরাণ অনুসারে, রামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের পর বশিষ্ঠ মুনির নিকট উপস্থিত হয়ে ব্রাহ্মণ হত্যার (রাবণ ব্রাহ্মণ ছিলেন) জন্য নিজেকে শুদ্ধ করতে তীর্থ যাত্রা করার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। তখন বশিষ্ঠ মুনি তাঁকে ধর্মারণ্যে গিয়ে যোগসাধনা করার উপদেশ দেন। ধারণা করা হয় এই ধর্মারণ্যই আজকের মধেরা। ভগবান রামচন্দ্র এই স্থানে সীতাপুর নামে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে লোকবিশ্বাস রয়েছে।
সুলতান মাহমুদ গজনী যখন সোমনাথ মন্দির ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা ধ্বংস এবং লুট করছিলেন, ঠিক সেই সময় ১০২৬ সালে মধেরাতে সোলাঙ্কি রাজা ভীমদেব-১ এই সূর্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
আরো পড়ুনঃ ভারতের এই শিব মন্দিরের নন্দী মূর্তিটি প্রতি বছর একটু একটু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে!
প্রথমবারের মতো এই মধেরা সূর্য মন্দির ধ্বংস করার চেষ্টা করেন মুসলিম শাসক আলাউদ্দিন খিলজি। ধ্বংসের আগে এখানে বিষ্ণু, শীতলা, গণেশ, কালী ও নটরাজের মন্দির ছিল। মোট মন্দির সংখ্যা ছিল ১০৮। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি সেগুলি ধ্বংস করেন। ধ্বংস ও ক্ষতি সাধনের পরেও যা অবশিষ্ট আছে, মন্দিরের বিশেষত্ব বুঝানোর জন্য তা যথেষ্ট। এই মন্দিরের ডিজাইন দেখে তৎকালীন ভারতবর্ষের সংখ্যাতত্ত্ব ও জ্যোতিষশাস্ত্রের জ্ঞান কোন পর্যায়ে ছিল তাঁর ধারণা পাওয়া যায়। সূর্য যখন বিষুবীয় সময়ে পৌছাতো, তখন সূর্যের প্রথম রশ্নি মন্দিরে স্থাপিত একটি সূর্যের ছবির উপর পড়ত।
মধেরা সূর্য মন্দিরের ছিল তিনটি প্রধান অংশঃ সূর্য কুণ্ড, সভা মণ্ডপ ও গুরা মণ্ডপ। সূর্য কুণ্ডের আরেক নাম রাম কুণ্ড। কুণ্ডটি বেশ বড় এবং আয়তাকার আকৃতির। এই কূণ্ড পবিত্র জল রাখা হতো। সূর্যদেবকে পুজোর আগে এখানে ভক্তরা অবগাহন করতো।
ভারতীয়দের গাণিতিক ও জ্যামিতিক উৎকর্ষতার এক অনন্য নিদর্শন সূর্য কুণ্ড। ড্যাজলিং প্যাটার্নে এর চারপাশ কম্পোজিশন করা। এটি অসংখ্য পাথরের তৈরি সিঁড়ি তে বিন্যস্ত যাতে খুব সহজে ভক্তরা নিচে নামতে পারত। এই সিঁড়ি গাত্রে ১০৮ টি কুঠি আছে। সনাতন হিন্দু ধর্মে ১০৮ সংখ্যাটির আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। ১০৮ সংখ্যাটি হিন্দুদের কাছে পবিত্র সংখ্যা কারণ জপমালাতে ১০৮ টি মার্বেল সদৃশ বস্তু থাকে।
আরো পড়ুনঃ ৫১ শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান এবং কোথায় সতীর কোন অঙ্গ পড়েছিল জেনে নিন
সভা মণ্ডপ তৈরী হয়েছিল ভক্তদের সমাবেশের জন্য। এটি সবদিকে খোলা। এই মণ্ডপটি ৫২টি অতি দুর্বোধ্য ও জটিল কারুকার্যময় নকশা খোদাইকৃত খিলানের মাধ্যমে ভিত দেওয়া। এখানে ৫২টি খিলান ব্যবহারের মাধ্যমে সৌর বছরের ৫২ সপ্তাহকে বুঝানো হয়েছে। খিলানগুলোতে মহাভারত, রামায়ণ ও শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সভা মণ্ডপ ও মন্দিরের মাঝে আকর্ষণীয় পিলার ও খিলানে নির্মিত একটি সুন্দর হল ঘর রয়েছে। এর সামনের দিক ধ্বংস করা হয়েছিল, পরবর্তীকালে যার অংশ বিশেষ পুনঃনির্মাণ করা হয়। দেয়ালে ১২টি কুলঙ্গির মাধ্যমে সূর্যের ১২টি রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই ১২ সংখ্যা দ্বারা সৌরবর্ষের ১২ মাসকে বুঝানো হয়েছে।
মধেরা সূর্য মন্দিরের বিভিন্ন অংশের শিল্পকলাতে যৌনাবেদনমূলক বিভিন্ন মোটিফ লক্ষ করা যায়। তৎকালীন সময়কালে যৌনতা কোন নিষিদ্ধ বিষয় ছিলনা। ফলে মধেরা সূর্য মন্দিরের দেয়ালে যৌন আবেদনমূলক বিভিন্ন ভাস্কর্যের দেখা পাওয়া যায়।
প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের ৩য় সপ্তাহে এই মধেরা সূর্য মন্দির প্রাঙ্গণে নৃত্য উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। গুজরাত পর্যটন কর্পোরেশন এই নৃত্য উৎসবের আয়োজন করে থাকে।
আরো পড়ুনঃ মুসলিম প্রধান ইন্দোনেশিয়ার জাভায় হাজার বছরের পুরনো শিব মন্দির প্রাম্বানান মন্দির