পশুপতিনাথ মন্দির নেপালের হাজার বছরের পুরনো মন্দির
পশুপতিনাথ মন্দির একটি প্রাচীন ও বিখ্যাত শিব মন্দির। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর পূর্ব দিকে বাগমতী নদীর তীরে পশুপতিনাথ মন্দির অবস্থিত। অতি প্রাচীন কাল থেকে সনাতন হিন্দু ধর্মানুসারীদের নিকট এই মন্দিরের রয়েছে অন্য রকম গুরুত্ব। ১৯৭৯ সালে এই মন্দির কমপ্লেক্সটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সনাতন ধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতা শিবের আরেক নাম পশুপতিনাথ। সেই নামেই এই মন্দিরের নাম রাখা হয়েছে পশুপতিনাথ মন্দির। এই মন্দির সম্পর্কে অনেক পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে।
আরো পড়ুনঃ নেপাল কি এখনো হিন্দুরাষ্ট্র?
প্রচলিত কাহিনী থেকে জানা যায়, একবার শিব ও পার্বতী কাঠমান্ডুর বাগমতী নদীর তীরে ভ্রমণ করছিলেন। নদী তীরবর্তী এ উপত্যকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে শিব ও পার্বতী হরিণের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতে থাকেন।
এদিকে স্বর্গালোকের দেবতারা পড়েছেন মহাবিপদে। অনেক কষ্টে শিবকে খুঁজে পেলেও শিব এই স্থান থেকে ফিরে যেতে আপত্তি জানালেন। দেবতাদের অনুনয়-বিনয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি রাজী হন এবং বলেন যেহেতু এই স্থানে তিনি হরিণ বেশে ঘুরেছেন, তাই তিনি এই স্থানে পশুদের অধিকর্তা হিসেবে পরিচিতি পাবেন। সেই থেকে আজ অবধি এখানে দেবাদিদেব শিবকে পশুপতিনাথ হিসেবে পূজা করা হচ্ছে।
এই মন্দির কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়না। তবে অনেক ঐতিহাসিকের মতে, খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতেও নেপালের এই স্থানে পশুপতিনাথ মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল।
নেপালের ঐতিহ্যবাহী প্যাগোডা রীতিতে এই মন্দিরটি চারকোণা। কাঠের কারুকাজ ও কৌণিক গঠন সব কিছুই নেপালের ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের অংশ। মন্দিরটির সারা গায়ে স্বর্ণ ও রৌপ্যের কারুকাজ রয়েছে। মন্দিরের দেয়ালে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। দুই স্তর বিশিষ্ট ছাদ তামা দ্বারা তৈরী। তামার উপর স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া। মন্দিরের চারটি প্রধান দরজাই রূপা দিয়ে মোড়া। প্রতিটি দরজার পাশে স্বর্ণ দিয়ে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। মূল মন্দিরে রয়েছে কালো পাথরে নির্মিত শিবলিঙ্গ।
আরো পড়ুনঃ নেপালের শীর্ষ ১০ হিন্দু মন্দির
নেপালে যখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে হিন্দু ধর্ম ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় পৌছায়, তখন সেখানে হাজির হন শিবাবতার আচার্য শঙ্কর। নেপালের রাজ সিংহাসনে তখন ঠাকুরী বংশের রাজা শিবদেব। শিবদেব নিজে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছেন, তাই পশুপতিনাথ মন্দিরের প্রতি তিনি দৃষ্টিহীন ছিলেন। এমন অবস্থায় আচার্য শঙ্করের আগমনে আবার প্রাণ ফিরে পায় পশুপতিনাথ মন্দির।
এসময় রাজা শিবদেব আচার্যের ধর্ম উপদেশ শুনে আকৃষ্ট হন এবং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আচার্য শঙ্কর রাজাকে মন্দিরে পূজা অর্চনায় যত্নশীল হওয়ার আহবান জানান। আচার্য শংকর নিয়ম করলেন এই দক্ষিণ ভারতের ভট্ট উপাধিধারী উপযুক্ত ব্রাহ্মণেরা এই মন্দিরের পুরোহিত হবেন। তারপর রাজা এই মন্দিরের সার্বিক উন্নতি করেন। পশুপতিনাথ মন্দির প্রাঙ্গণে শংকরাচার্যের একটি মঠ রয়েছে।
পশুপতিনাথ মন্দিরের মূল চূড়া স্বর্ণ দিয়ে মোড়া। পশ্চিমদিকের দরজার সামনে ব্রোঞ্জের তৈরি ও স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া একটি বিশাল নন্দী মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের ছাদের নিচের দিকে শিব-পার্বতী, গণেশ, কার্তিক, যোগিনীদের মূর্তিসহ নানা দেব-দেবীর মূর্তি রয়েছে। এছাড়া রামায়ণ, মহাভারতসহ হিন্দু পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী মন্দিরের দেয়ালে খোদাই করা রয়েছে।
এই মন্দির প্রধানত শৈবক্ষেত্র হলেও বৈষ্ণব, শাক্ত, গণপৈত্য, রামায়েত তান্ত্রিক ও বৌদ্ধ সকলের কাছেই মহাপবিত্র তীর্থস্থান। এখানে মহাশিবরাত্রী ছাড়াও প্রায় সকল হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়।
পশুপতিনাথ মন্দিরের অনিন্দ্য সুন্দর শৈল্পিক কারুকার্য ও ঐতিহ্যের জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক ও তীর্থযাত্রীরা এখানে ভিড় করেন। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পর্যটকদের কাছে এই মন্দির তুলনামূলক বেশী আকর্ষণীয় তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত।
আরো পড়ুনঃ হংসেশ্বরী মন্দির – হুগলীর বাঁশবেড়িয়ার প্রাচীন ও রহস্যময় কালী মন্দির!