দেশে দেশে হিন্দুধর্ম

মুসলিম দেশ মালয়েশিয়ায় হিন্দু ধর্মের হাজার বছরের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস

মালয়েশিয়ায় হিন্দু ধর্ম

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ মালয়েশিয়া। তেরটি রাজ্য এবং তিনটি ঐক্যবদ্ধ প্রদেশ নিয়ে গঠিত মালয়েশিয়ার মোট আয়তন ৩,২৯, ৮৪৫ বর্গকিমি। মালয়েশিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা মাত্র তিন কোটি সাতাশ লক্ষ বাহাত্তর হাজার।

২০১০ সালের সর্বশেষ আদমশুমারী অনুযায়ী মালয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যার ৬১.৩% মুসলিম, ১৯.৮% বৌদ্ধ, ৯.২% খ্রীস্টান এবং ৬.৩% হিন্দু। অর্থাৎ সনাতন হিন্দু ধর্ম মালয়েশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম ধর্ম এবং মালয়েশিয়ায় বর্তমানে বসবাসকারী হিন্দু সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষ।

মালয়েশিয়ার বেশীর ভাগ হিন্দু বাস করেন পেনিনসুলার মালয়েশিয়ায়। মালয়েশিয়ার চারটি প্রদেশে হিন্দু জনসংখ্যা তুলনামূলক বেশী। রাজ্যগুলো হলো সেলাঙ্গর, নেগেরি সেম্বিযান, পেরাক এবং কুয়ালালামপুর। আর সবচেয়ে কম হিন্দু বাস করেন সাবাহ প্রদেশে।

মালয়েশিয়া-হিন্দু-উৎসব
হিন্দু উৎসবে মালয়েশিয়ান হিন্দু নারী

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষ ও চিন থেকে প্রচুর মানুষ কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় মালয় উপদ্বীপে। ধারণা করা হয় প্রায় ১৭০০ বছর আগে ভারতীয়রা মালয় উপদ্বীপে তাদের প্রথম পদচিহ্ন আঁকে। আর তাদের সাথে সাথে মালয়েশিয়ায় বিস্তার হয় ভারতীয় সংস্কৃতি এবং সংস্কৃত ভাষার। প্রার্থনার প্রয়োজনে ভারতীয় স্থাপত্যধারায় নির্মিত হতে থাকে মন্দির। মালয় উপদ্বীপের উপকূলজুড়ে তৈরী হয় অনেকগুলো হিন্দু শাসিত ছোট রাজ্য।

আরো পড়ুনঃ সিঙ্গাপুরে হিন্দু ধর্মের এতো শক্তিশালী অবস্থানের প্রকৃত কারণ কী!

এই হিন্দু রাজ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, খ্রিস্টীয় ২য় শতাব্দীর গঙ্গা নেগারা, লঙ্কাসুকা, ৪র্থ শতাব্দীর কেদাহ। খ্রিষ্টীয় ৭ম থেকে ১৩ শতকের মধ্যে এই রাজ্যগুলো, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা কেন্দ্রিক, শ্রীবিজয় নামক প্রতাপশালী হিন্দু সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে।

পরবর্তীকালে উপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশদের মাধ্যমে আরো অধিক সংখ্যক ভারতীয়, শ্রমিক হিসেবে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমায়। এভাবেই ভারতীয়দের মাধ্যমেই মালয়েশিয়ায় বিস্তার ঘটে সনাতন হিন্দু ধর্মের।

মালয়েশিয়ান হিন্দু ধর্ম বেশ বৈচিত্রময়। শহরের বড় বড় মন্দিরগুলো নির্দিষ্ট দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। এছাড়া মালয়েশিয়ায় ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তির ওপর গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট ছোট মন্দির। মালয়েশিয়াতে হিন্দু ধর্মের দুই বিশেষ ধারা, শৈব ও বৈষ্ণব মতবাদের প্রচুর অনুসারী রয়েছেন।

মালয়েশিয়ায় ইসকনের প্রচুর সংখ্যক অনুসারী রয়েছেন। কুয়ালালামপুর সহ সমগ্র মালয়েশিয়ায় ইসকনের অসংখ্য মন্দির রয়েছে। ইসকনের উদ্যেগে মালয়েশিয়ায় বেশ বড় পরিসরে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

আর পড়ুনঃ এক কালের হিন্দু দেশ আফগানিস্তানে বর্তমানে কী হিন্দু আছে?

এছাড়া মালয়েশিয়ান হিন্দুদের মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ১৯৪০ সালে মালয়েশিয়ার পেতালিং জায়াতে সর্বপ্রথম রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মালয়েশিয়া ভ্রমণকালে রামকৃষ্ণ মিশন চত্বরে স্বামী বিবেকানন্দের একটি মূর্তি উন্মোচন করেন।

মালয়েশিয়া ধর্ম
বিবেকানন্দ আশ্রম, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া

১৯০৪ সালে শ্রীলঙ্কার অভিবাসী হিন্দুদের দ্বারা কুয়ালালামপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় বিবেকানন্দ আশ্রম। এই আশ্রমের সামনে স্বামী বিবেকানন্দের একটি ব্রোঞ্জ মূর্তি রয়েছে। ২০১৬ সালে স্বামী বিবেকানন্দের ব্রোঞ্জ মূর্তিসহ এই আশ্রমকে মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

মালয়েশিয়ার বিখ্যাত মন্দিরগুলোর মধ্যে বাতু কেভের নাম সবার আগে আসে।কুয়ালালামপুরের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র বাতু কেভস। এখানকার বিশাল আকৃতির পাহাড়ে রয়েছে চুনাপাথরে তৈরী একাধিক প্রাগৈতিহাসিক গুহা। গুহাগুলোতেই স্থাপন করা হয়েছে হিন্দু দেবতাদের মন্দির। পাহাড়ের সামনে স্থাপন করা হয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হিন্দু দেবতার মূর্তি। স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি মুরুগান নামে পরিচিত। তামিল ভাষায় দেবতা কার্তিকের আরেক নাম মুরুগান।

মালয়েশিয়া
বাতু কেভের সামনে মুরুগানের বিশালাকার মূর্তি

আরো পড়ুনঃ দক্ষিণ আমেরিকার দেশ গায়ানায় হিন্দু ধর্ম যেভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরী করলো!

মালয়েশিয়ার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য মন্দিরগুলো হলো, শ্রী মহা মারি আম্মান মন্দির, শ্রী পয়াতা মূর্তি মন্দির, মারান মুরুগান মন্দির, ক্লাং পেরুমাল মন্দির, শ্রী আয়ান্নার মন্দির, শ্রী শক্তি দেবস্থানম প্রভৃতি।

মালয়েশিয়ার হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দিওয়ালী ও থাই পুসাম। থাই পুসাম হচ্ছে দেবতা মুরুগান অর্থাৎ কার্তিককে কেন্দ্র করে একটি বৃহৎ উৎসব। দিওয়ালী ও থাই পুসামে সমগ্র মালয়েশিয়াব্যাপী সরকারী ছুটি। এছাড়া পোঙ্গল এবং নবরাত্রি উৎসবও মালয়েশিয়ান হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। মালয়েশিয়ায় হিন্দু ধর্ম!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!