Featuredদুর্গাপূজা

পূজারিণীদের উৎসব: দুর্গা পূজার আচার-অনুষ্ঠানে নারীদের ভূমিকা

দুর্গা পূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি শক্তির আরাধনা, নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক। দেবী দুর্গার অশুভের বিনাশী রূপ নারীশক্তির প্রতীকী উপস্থাপন, যা আজও সমাজে নারীর সাহসিকতা, সংগ্রাম, এবং সাফল্যের প্রতিচ্ছবি। দুর্গা পূজার আচার-অনুষ্ঠানে নারীদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তা এই পূজার ঐতিহ্যবাহী ভাবনার সাথে মিশে আছে। এই লেখাতে আমরা আলোচনা করব পূজারিণীদের ভূমিকা ও দায়িত্ব সম্পর্কে, যা দুর্গা পূজার আচার-অনুষ্ঠানে অতি গুরুত্বপূর্ণ।

নারীদের শক্তি ও পূজারিণীদের ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা

দেবী দুর্গা হলেন সর্বোচ্চ নারীশক্তির প্রতীক। দুর্গা পূজা তাঁর সম্মান ও আরাধনার এক বিশেষ সময়। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই দুর্গা পূজায় পূজারিণীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছেন। যদিও পূজার মূল মন্ত্রোচ্চারণ ও হোম যজ্ঞ সাধারনত পুরোহিতরাই সম্পন্ন করেন, তবে পূজার অঙ্গ হিসেবে নারীদের পালনীয় আচার-অনুষ্ঠানের একটি আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।

দুর্গা পূজায় পূজারিণীদের কাজ শুরু হয় দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে। মহালয়ার সময় দেবীকে মর্ত্যে আনার জন্য নানা আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। প্রতিমা গড়া থেকে শুরু করে দেবীকে চরণামৃত স্নান করানো, মূর্তির চোখ আঁকা, এবং দেবীকে বরণ করার মত আচারগুলোতে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা যায়।

পূজারিণীদের মূল দায়িত্ব ও আচার-অনুষ্ঠান

পূজার সময় পূজারিণীরা নানা দায়িত্ব পালন করেন। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:

  1. দেবী বরণ: মহাষষ্ঠীর দিন দেবী দুর্গাকে ঘরে বরণ করে নেওয়া হয়। পূজারিণীরা সুগন্ধি চন্দন, ফুল, ধূপ, ও দীপ নিয়ে দেবীকে ঘরে স্বাগত জানান। এই আচারটি দেবীর প্রতি ভক্তি প্রকাশের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
  2. পুষ্পাঞ্জলি প্রদান: সপ্তমী, অষ্টমী, এবং নবমীর দিনে পূজারিণীরা দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন। ফুল, বেলপাতা, এবং ধূপ নিয়ে তারা দেবীর সামনে অঞ্জলি দেন। এতে তাঁদের ভক্তির প্রকাশ ঘটে এবং দেবী দুর্গার আশীর্বাদ লাভের আশা জাগে।
  3. নবপত্রিকা স্নান: মহাসপ্তমীর দিন সকালে নবপত্রিকা স্নানের আচারটি পূজারিণীদের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। কলা, কুমড়ো, আখসহ নয়টি উদ্ভিদ একত্রিত করে দেবীর একটি রূপ হিসেবে পুজো করা হয়। পূজারিণীরা নবপত্রিকাকে নদীর জলে স্নান করিয়ে মণ্ডপে স্থাপন করেন।
  4. সিঁদুর খেলা: বিজয়া দশমীর দিন দেবী বিসর্জনের পূর্বে পূজারিণীরা দেবীর মূর্তিতে সিঁদুর পরিয়ে দেন। এরপর, তাঁরা একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এই আচারটি নারীদের আনন্দের অংশ, যা দেবী দুর্গার প্রতি তাঁদের ভালোবাসা ও আশীর্বাদের প্রতীক।
  5. ভোগ বিতরণ: পূজার সময় দেবীকে নিবেদন করা ভোগ প্রস্তুত করা ও বিতরণের কাজেও পূজারিণীরা সক্রিয় থাকেন। পায়েস, মিষ্টি, এবং ফলসহ অন্যান্য নিরামিষ ভোগ দিয়ে দেবীর পূজো সম্পন্ন করা হয়।

নারীর ক্ষমতায়ন ও পূজারিণীদের ভূমিকা

দুর্গা পূজায় নারীদের এই ভূমিকাগুলো কেবল আচার-অনুষ্ঠানের অংশ নয়; এটি নারীর শক্তি, যোগ্যতা, এবং সৃষ্টিশীলতার উদযাপন। দেবী দুর্গা যেমন দশভুজা হয়ে সকল বিপদকে জয় করেন, তেমনি পূজারিণীরাও পূজার আচার-অনুষ্ঠানে তাদের কর্মদক্ষতা ও প্রতিভার পরিচয় দেন।

এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তাঁরা নিজেরা যেমন পূর্ণতা পান, তেমনি অন্য নারীদের জন্যও একটি আদর্শ স্থাপন করেন। পূজার এই কর্মযজ্ঞ নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক অগ্রগতি, এবং পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক।

দুর্গা পূজায় পূজারিণীদের ভূমিকা এক কথায় অপরিসীম। তাঁরা তাঁদের একাগ্রতা, ভালোবাসা, এবং নিষ্ঠা দিয়ে পূজাকে সম্পূর্ণতা দেন। প্রতিটি আচার, অনুষ্ঠানে তাঁদের অংশগ্রহণ দুর্গা পূজার ঐতিহ্যকে আরো সমৃদ্ধ করে তোলে। পূজার মাধ্যমে তাঁরা শুধু দেবীর আরাধনাই করেন না, বরং তাঁরা নিজেদের মধ্যেও দেবীর শক্তিকে ধারণ করে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা পান।

দুর্গা পূজা তাই কেবল দেবীর আরাধনা নয়; এটি নারীর ক্ষমতায়নের এক মঙ্গলযাত্রা, যেখানে পূজারিণীরা দেবীরই এক রূপ হিসেবে পূজিত হন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!