Featuredএকাদশীএকাদশী মাহাত্ম্য

উত্থান একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য

হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একাদশী তিথির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। একাদশী শব্দের অর্থ হলো ‘এগারো’ এবং এই দিনটি মাসের কৃষ্ণপক্ষ ও পূর্ণিমা পক্ষের একাদশ তিথি হিসেবে পালিত হয়। উত্থান একাদশী একটি বিশেষ একাদশী, যা সাধারণত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ‘উত্থান’ বা ‘উত্থানতিথি’ নামে পরিচিত। এটি বিশেষত কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে উদযাপিত হয় এবং এটি কৃষ্ণের ভক্তদের জন্য একটি অতি শুভ সময়।


উত্থান একাদশী ২০২৪ উপোস ও পারণের সময়সূচী

তারিখবারএকাদশীপারণের সময়সূচি (পরদিন)
১২ নভেম্বর, ২০২৪মঙ্গলবারউত্থান একাদশী (শুক্লপক্ষ)০৬:২১-০৬:৫৬

উত্থান একাদশী মাহাত্ম্য

কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী মাহাত্ম্য স্কন্দপুরাণে ব্রহ্মা নারদ সংবাদে বর্ণিত আছে।

মহারাজ যুধিষ্ঠির বললেন – হে পুরুষোত্তম! কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম আমার কাছে কৃপা করে বর্ণনা করুন।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন – হে রাজন! কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী ‘উত্থান’ বা ‘প্রবোধিনী’ নামে পরিচিত। প্রজাপতি ব্রহ্মা পূর্বে নারদের কাছে এই একাদশীর মহিমা কীর্তন করেছিলেন। এখন তুমি আমার কাছে সেই কথা শ্রবণ কর।

দেবর্ষি নারদ প্রজাপতি ব্রহ্মাকে বললেন – হে মহাত্মা! যে একাদশীতে ভগবান শ্রী গোবিন্দ শয়ন থেকে জেগে ওঠেন, সেই একাদশীর মাহাত্ম্য আমার কাছে সবিস্তারে বর্ণনা করুন।

ব্রহ্মা বললেন – হে নারদ! উত্থান একাদশী যথার্থই পাপনাশিনী, পুণ্যকারী ও মুক্তি প্রদানকারী। এই ব্রত নিষ্ঠা সহকারে পালন করলে এক হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ ও শত শত রাজসূয় যজ্ঞের ফল লাভ হয়। জগতের দুর্লভ বস্তুর প্রাপ্তির কথা কি আর বলব।

এই একাদশী ভক্তি পরায়ন ব্যক্তিকে ঐশ্বর্য, প্রজ্ঞা, রাজ্য ও সুখ প্রদান করে। এই ব্রতের প্রভাবে পর্বত প্রমাণ পাপরাশি বিনষ্ট হয়। যারা একাদশীতে রাত্রি জাগরণ করেন, তাদের সমস্ত পাপ ভস্মীভূত হয়। শ্রেষ্ঠ মুনিগণ তপস্যার দ্বারা যে ফল লাভ করেন, এই ব্রতের উপবাসে তা পাওয়া যায়। যথাযথ ভাবে এই ব্রত পালনে আশাতীত ফল লাভ হয়। কিন্তু অবিধিতে উপবাস করলে স্বল্পমাত্র ফল লাভ হয়।

উত্থান একাদশী ২০২৪
উত্থান একাদশী ২০২৪

যারা এই একাদশীর ধ্যান করেন, তাদের পূর্বপুরুষেরা স্বর্গে আনন্দে বাস করেন। এই একাদশী উপবাস ফলে ব্রহ্মহত্যা জনিত ভয়ঙ্কর নরক যাতনা থেকে নিস্তার পেয়ে বৈকুণ্ঠগতি লাভ হয়। অশ্বমেধ যজ্ঞ দ্বারাও যা সহজে লাভ হয় না, তীর্থে স্বর্ণ প্রভৃতি দান করলে যে পুণ্য অর্জিত হয়, এই উপবাসের রাত্রি জাগরণে সেই সকল অনায়াসে লাভ হয়।

যিনি সঠিক ভাবে উত্থান একাদশী অনুষ্ঠান করেন, তার গৃহে ত্রিভুবনের সমস্ত তীর্থ এসে উপস্থিত হয়। হে নারদ! বিষ্ণুর প্রিয়তমা এই একাদশী উপবাস ফলে সর্ব শাস্ত্রে জ্ঞান ও তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে চরমে মুক্তি লাভ হয়। যিনি সমস্ত লৌকিক ধর্ম পরিত্যাগ করে ভক্তি সহকারে এই ব্রত পালন করেন তাকে আর পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে হয় না। এমনকি মন ও বাক্য দ্বারা অর্জিত পাপরাশিও শ্রী গোবিন্দের অর্চনে বিনষ্ট হয়।

হে বৎস! এই ব্রতে শ্রদ্ধা সহকারে শ্রী জনার্দনের উদ্দেশ্যে স্নান, দান, জপ, কীর্তন ও হোমাদি করলে অক্ষয় লাভ হয়। যারা উপবাস দিনে শ্রী হরির প্রতি ভক্তি সহকারে দিন যাপন করেন, তাদের পক্ষে জগতে দুর্লভ বলে আর কিছু নেই। চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণে স্নান করলে যে পুণ্য হয়, এই উপবাসে রাত্রি জাগরণ করলে তার সহস্র গুন সুকৃতি লাভ হয়। তীর্থে স্নান, দান, জপ, হোম ধ্যান আদির ফলে যে পুণ্য সঞ্চিত হয়, উত্থান একাদশী পালন না করলে সে সমস্ত নিষ্ফল হয়ে যায়। হে নারদ! শ্রী হরি বাসরে শ্রী জনার্দনের পূজা বিশেষ ভক্তি সহকারে করবে। তা না হলে শতজন্মার্জিত পুণ্য ও বিফল হয়।

হে বৎস! যিনি কার্তিক মাসে সর্বদা ভাগবত শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করেন, তিনি সর্বপাপ মুক্ত হয়ে সমস্ত যজ্ঞের ফল লাভ করেন। ভগবান হরি ভক্তি মূলক শাস্ত্রপাঠে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। কিন্তু দান, জপ, যজ্ঞাদি দ্বারা তেমন প্রীত হন না। এই মাসে শ্রী বিষ্ণুর নাম, গুন, রূপ, লীলাদি শ্রবণ কীর্তন অথবা শ্রীমদ্ভাগবত আদি শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠের ফলে শত শত গোদানের ফল লাভ করা যায়।

অতএব হে মুনিবর! কার্তিক মাসে সমস্ত গৌণধর্ম বর্জন করে শ্রী কেশবের সামনে হরি কথা শ্রবণ কীর্তন করা কর্তব্য। কোনো ব্যক্তি যদি ভক্তি সহকারে এই মাসে ভক্তসঙ্গে হরিকথা শ্রবণ কীর্তন করেন, তবে তার শতকুল উদ্ধার হন এবং হাজার হাজার দুগ্ধবতী গাভী দানের ফল অনায়াসে লাভ হয়। এই মাসে পবিত্র ভাবে শ্রীকৃষ্ণের রূপ গুনাদির শ্রবণ কীর্তনে দিন যাপন করলে তার আর পুনর্জন্ম হবে না। এই মাসে বহু ফলমূল, ফুল, অগুরু, কর্পূর ও চন্দন দিয়ে শ্রী হরির পূজা করা কর্তব্য।

সমস্ত তীর্থ ভ্রমণ করলে যে পুণ্য হয়, উত্থান একাদশীতে শ্রীকৃষ্ণ পাদপদ্মে অর্ঘ্য প্রদানে তার কোটি গুন সুকৃতি লাভ হয়। শ্রবণ কীর্তন, স্মরণ বন্দনাদি নববিধা ভক্তির সাথে তুলসীর সেবার জন্য যারা বীজ রোপণ, জল সেচন ইত্যাদি করেন, তারা মুক্তি লাভ করে বৈকুণ্ঠ বাসী হন।

হে নারদ! সহস্র সুগন্ধি পুষ্পে দেবতার অর্চনে বা সহস্র সহস্র যজ্ঞ ও দানে যে ফল লাভ হয়, এই মাসে হরি বাসরে একটি মাত্র তুলসী পাতা শ্রী ভগবানের চরণ কমলে অর্পণ করলে তার অনন্ত কোটি গুন লাভ করা যায়।


উত্থান একাদশী পালন করলে কী হয়?

  1. পবিত্রতা ও সাধনা: উত্থান একাদশী দিনটি বিশেষ পবিত্র হিসেবে গণ্য হয়। এই দিনে ভক্তরা সারা দিন উপবাস পালন করেন এবং শুদ্ধভাবে মন্ত্রপাঠ ও ভগবানের পুজো করেন। এটি আত্মশুদ্ধি ও সাধনার জন্য একটি মহৎ সুযোগ।
  2. কৃষ্ণের মহিমা: এই দিনটি মূলত ভগবান কৃষ্ণের প্রতি নিবেদিত। বলা হয়, এই দিনটি কৃষ্ণের উত্থানের সাথে যুক্ত, যখন তিনি দুঃখী ও বিপন্ন ভক্তদের মুক্তি দিতে অবতার গ্রহণ করেছিলেন। তাই এই দিনে কৃষ্ণকে স্মরণ করে ভক্তরা বিশেষ পুজা ও প্রার্থনা করেন।
  3. শুভ ফল লাভ: উত্থান একাদশীতে নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ এবং উপবাস পালন করা হয়। এই দিনে কৃত পুণ্যকর্ম এবং সাধনার ফলস্বরূপ ভক্তরা সুখ, শান্তি, ও সমৃদ্ধি লাভ করেন। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে, এই দিনটি যিনি সঠিকভাবে পালন করেন, তিনি সারা বছর আনন্দ ও সমৃদ্ধিতে কাটাবেন।
  4. দানে দানশীলতা: এই দিনটি দানে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। ভক্তরা এই দিনে দান করতে পারলে তাদের পুণ্যকর্ম বৃদ্ধি পায়। দানশীলতা শুধু ধনসম্পত্তির নয়, বরং ভালো কাজ এবং সেবা করাকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
  5. আধ্যাত্মিক উন্নতি: উত্থান একাদশী ভক্তদের জন্য আধ্যাত্মিক উন্নতির একটি উপলক্ষ। উপবাস এবং মন্ত্র জপের মাধ্যমে আত্মসংযম এবং আত্মপ্রত্যয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যা জীবনের বিভিন্ন দিকের উন্নতি সাধনে সহায়ক।

উত্থান একাদশী একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তিথি যা হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই দিনে ভক্তরা শুদ্ধতা, দানে দানশীলতা, এবং কৃষ্ণভক্তিতে নিবেদিত হন। এটি শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং আত্মা ও চেতনার উন্নতির একটি মহৎ সুযোগ। তাই উত্থান একাদশী পালন করা আমাদের সকলের জন্য একটি সম্মানের বিষয় এবং এটি আমাদের জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধির ধারক হতে পারে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!