Featuredদুর্গাপূজা

শারদীয় দুর্গাপূজার ইতিহাস ও গুরুত্ব: বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের গল্প

দেবী দুর্গা প্রতীক হয়ে ওঠেন মা-শক্তির, যিনি জীবনের সমস্ত অশুভ শক্তি, দুঃখ-কষ্ট, এবং দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করেন।

শারদীয় দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এটি শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বাঙালি সংস্কৃতির এক অন্যতম প্রতীক। দেবী দুর্গার এই পূজা তার অসুর-বিনাশী শক্তির উদযাপন এবং অশুভ শক্তির ওপর শুভ শক্তির বিজয়ের প্রতীক হিসেবে পালিত হয়। আসন্ন ৯ অক্টোবর থেকে আবারও শুরু হতে যাচ্ছে এই মহোৎসব, যেখানে দেবী দুর্গার আরাধনা, সামাজিক সংহতি, এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটবে। এবার আসুন, শারদীয় দুর্গাপূজার ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।

দুর্গাপূজার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

দুর্গাপূজার ইতিহাস বহু প্রাচীন এবং ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। “দেবীমাহাত্ম্য” বা “দুর্গাসপ্তশতী” নামক হিন্দু ধর্মগ্রন্থে প্রথম দুর্গাপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থ অনুসারে, মহিষাসুর নামক এক শক্তিশালী অসুরের অত্যাচার থেকে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য দেবতারা মহাদেবী দুর্গার আহ্বান করেছিলেন। দেবী দুর্গা মহিষাসুরের বিরুদ্ধে ত্রয়োদশ দিনের এক মহাযুদ্ধে জয়লাভ করেন, যা মহালয়ার দিন থেকে দশমী পর্যন্ত উদযাপিত হয়।

পণ্ডিতরা মনে করেন, প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন রাজ্য এবং সমাজে দুর্গাপূজা পালিত হতো। তবে বাংলায় দুর্গাপূজার উৎসবমুখর উদযাপনের প্রচলন শুরু হয় মূলত রাজা কংসনারায়ণের (১৬০৬-১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দ) সময়। পরবর্তীতে জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের উদ্যোগে বারোয়ারি বা সার্বজনীন দুর্গাপূজার প্রচলন ঘটে, যা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। ১৯১০ সালে কলকাতার প্রথম বারোয়ারি পূজা আয়োজন করা হয় “ভাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব” নামে।

শারদীয় দুর্গাপূজা: উৎসবের রূপ ও ধরন

শারদীয় দুর্গাপূজা সাধারণত আশ্বিন মাসে পালিত হয়, তাই একে শারদীয়া পূজা বলা হয়। এই সময় বাংলার প্রকৃতিতে শরৎকালীন স্নিগ্ধতা বিরাজ করে, কাশফুলে ভরে ওঠে গ্রামবাংলার প্রান্তর। পূজার প্রস্তুতি মহালয়ার দিন থেকেই শুরু হয়, যেদিন দেবীর মর্ত্যে আগমনের সূচনা করা হয়। পরবর্তী পাঁচদিন মণ্ডপে মণ্ডপে দেবী দুর্গা, তার সন্তানদের (কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী) আরাধনা করা হয়।

দুর্গাপূজার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো দেবী প্রতিমার শোভা এবং তার আরাধনায় ব্যবহৃত বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান। ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং দশমী, প্রতিটি দিনেই ভিন্ন ভিন্ন রীতির মাধ্যমে পূজা পালিত হয়। মহাষ্টমীর দিন সন্ধিপুজা এবং নবমীর দিন কুমারীপুজার মাধ্যমে দেবীকে পূজিত করা হয়। দশমীতে দেবীর বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার সমাপ্তি ঘটে।

দুর্গাপূজার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

শারদীয় দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নয়, এটি সামাজিক মেলবন্ধনের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে নতুন পোশাক, উপহার, এবং মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে আনন্দ ভাগাভাগি হয়। পারিবারিক ও সামাজিক মিলনমেলার মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজা নতুন প্রজন্মের কাছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।

শিল্প, সাহিত্য, এবং সংগীতেও দুর্গাপূজার বিশেষ প্রভাব রয়েছে। প্রতিমাশিল্পী থেকে শুরু করে মণ্ডপসজ্জার কারিগর, সবারই থাকে উৎসবমুখর ব্যস্ততা। প্রতি বছর প্রতিমা তৈরিতে নতুনত্বের ছোঁয়া এনে শিল্পীরা দুর্গাপূজাকে সমৃদ্ধ করেন। এছাড়া, কাব্য, উপন্যাস, নাটক, এবং চলচ্চিত্রেও দুর্গাপূজার গুরুত্ব এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো লেখকরাও তাদের লেখনীতে দুর্গাপূজার বৈচিত্র্য তুলে ধরেছেন।

দুর্গাপূজার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব

দুর্গাপূজার মূল বার্তা হলো শক্তির পূজা। দেবী দুর্গা প্রতীক হয়ে ওঠেন মা-শক্তির, যিনি জীবনের সমস্ত অশুভ শক্তি, দুঃখ-কষ্ট, এবং দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করেন। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, এই পূজার মাধ্যমে তারা দেবীর আশীর্বাদ লাভ করবেন এবং তাদের জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি, এবং শান্তি আসবে। দুর্গাপূজার মাধ্যমে মানুষ জীবনের সংকটময় মুহূর্তে আশা এবং সাহসের দীক্ষা পায়।

শারদীয় দুর্গাপূজা বাঙালি সংস্কৃতির মূল উৎসব এবং আধ্যাত্মিকতার এক মহামিলন। ইতিহাস থেকে শুরু করে সমাজ, সংস্কৃতি, এবং ধর্মে এর প্রভাব অপরিসীম। প্রতি বছর দেবী দুর্গার আগমনে বাংলা নতুন প্রাণশক্তিতে জেগে ওঠে। এই পূজা শুধু ধর্মীয় উপাসনা নয়; বরং বাঙালির চিরন্তন ঐক্য, শান্তি, এবং শক্তির প্রতীক।

শুভ দুর্গাপূজা!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!