মহালয়া: দুর্গাপূজার আগমনী সুর ও ইতিহাসের পথচলা
মহালয়া কেবল দুর্গাপূজার আগমনী নয়; বরং এটি আমাদের পিতৃপুরুষদের স্মরণ করার, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এবং নিজেকে শুদ্ধ করার এক বিশেষ মুহূর্ত।
মহালয়া, বাঙালি হিন্দুদের কাছে দুর্গাপূজার আগমনী বার্তা। এটি দুর্গাপূজার এক বিশেষ উপাচার যা মর্ত্যে দেবী দুর্গার আগমন ঘোষণা করে। সাধারণত পিতৃপক্ষের শেষ দিন অর্থাৎ অমাবস্যা তিথিতে মহালয়া পালিত হয়। ২০২৪ সালে মহালয়া পালিত হবে ২ অক্টোবর। মহালয়ার মাধ্যমে শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এবার চলুন মহালয়ার ইতিহাস, গুরুত্ব, এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আচার-অনুষ্ঠানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।
মহালয়ার ইতিহাস: অতীত থেকে বর্তমান
মহালয়ার উৎসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ও পৌরাণিক কাহিনী। বলা হয়ে থাকে, “দেবীমাহাত্ম্য” বা “দুর্গাসপ্তশতী” গ্রন্থের মধ্যে মহালয়ার মূল কাহিনী লুকিয়ে আছে। এই গ্রন্থে দেবী দুর্গার অসুর-বিনাশের কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। মহালয়ার দিনেই দেবী দুর্গা মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন এবং পরে বিজয়ী হয়ে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা করেন। দেবীর এই বিজয়ের গাথা শুনতে ভক্তরা মহালয়ার ভোরে মন্ত্রপাঠ এবং চণ্ডীপাঠের আয়োজন করে থাকে।
প্রাচীনকালে মহালয়া মূলত দেবী দুর্গার আরাধনার এক বিশেষ পন্থা ছিল। মহালয়ার সঙ্গে এক বিশেষ আচার যুক্ত রয়েছে, যাকে ‘পিতৃতর্পণ’ বলা হয়। মহালয়ার দিনে ভক্তরা গঙ্গা বা নদীতে গিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য জল প্রদান করে।
মহালয়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পৌরাণিক কাহিনী
মহালয়ার সঙ্গে বেশ কয়েকটি পৌরাণিক কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কাহিনী হলো ‘পিতৃপক্ষ’ ও ‘মাতৃপক্ষ’-এর সংযোগ। মহালয়ার দিন ‘পিতৃপক্ষ’ শেষ হয়ে ‘মাতৃপক্ষ’ বা দেবীপক্ষ শুরু হয়। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, দেবী দুর্গা এই দিনেই মর্ত্যে আগমন করেন। দেবী দুর্গার আগমনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি, সমৃদ্ধি, এবং শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা ঘটে। মহালয়ার দিনটিকে তাই দেবীর আগমনী দিন হিসেবেই পালিত হয়।
মহালয়ার আচার-অনুষ্ঠান ও পালন
মহালয়ার দিনটি এক বিশেষ উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি করে। ভোরবেলায় “চণ্ডীপাঠ” এবং “মহিষাসুরমর্দিনী” স্তোত্র পাঠের মাধ্যমে মহালয়ার সূচনা করা হয়। মহালয়ার দিন ভক্তরা পবিত্র গঙ্গা বা নদীর তীরে গিয়ে তর্পণের মাধ্যমে তাদের পিতৃপুরুষদের স্মরণ করেন।
মহালয়ার সকালে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে রেডিওতে “মহিষাসুরমর্দিনী” স্তোত্রের সম্প্রচারের ঐতিহ্য বহু পুরনো। ১৯৩১ সালে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রথমবার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সম্প্রচার করা হয়, যা এখনো মহালয়ার অন্যতম অংশ হয়ে রয়েছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পণ্ডিত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ঐশ্বরিক কণ্ঠ, যা বাঙালির মনে দুর্গাপূজার আগমনের সুর বাজিয়ে দেয়।
মহালয়ার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
মহালয়ার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অপরিসীম। হিন্দু ধর্মে মহালয়া হলো সেই বিশেষ দিন যখন মর্ত্যলোকে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। এটি দেবী দুর্গার শক্তির আরাধনার এক বিশেষ মুহূর্ত। মহালয়ার দিন ভক্তরা দেবীর আরাধনায় নিজেদের শুদ্ধ করেন এবং তাদের জীবনকে পবিত্রতার পথে পরিচালিত করার জন্য দেবীর কাছে প্রার্থনা করেন।
মহালয়া হলো সেই সময় যখন মানুষ তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। তর্পণ বা জল প্রদান করার মাধ্যমে পিতৃপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয়। এটি ভক্তদের মনে স্মৃতির স্রোত বয়ে আনে এবং পারিবারিক বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করে।
মহালয়া এবং দুর্গাপূজার সম্পর্ক
মহালয়া ও দুর্গাপূজা একে অপরের পরিপূরক। মহালয়ার মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার আগমন ধ্বনিত হয়। মহালয়ার দিনই দেবী দুর্গার ‘বোধন’ সম্পন্ন হয়, যা দেবীর মর্ত্যে আগমনের প্রতীক। মহালয়ার পরবর্তী সাত দিন জুড়ে দেবী দুর্গার বোধন, অধিবাস, এবং আমন্ত্রণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এরপরই শুরু হয় দুর্গাপূজার মূল উৎসব।
মহালয়া বাঙালির জীবনে এক অনন্য আবেগ ও অনুভূতির দিন। এটি কেবল দুর্গাপূজার আগমনী নয়; বরং এটি আমাদের পিতৃপুরুষদের স্মরণ করার, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এবং নিজেকে শুদ্ধ করার এক বিশেষ মুহূর্ত। মহালয়ার মাধ্যমে বাঙালির মনে পূজার সুর বাজতে শুরু করে, এবং তাদের মধ্যে নতুন এক উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। মহালয়ার ইতিহাস এবং আচার-অনুষ্ঠান আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, এবং আধ্যাত্মিকতার গভীরে নিয়ে যায়।
শুভ মহালয়া!