জামাই ষষ্ঠী ২০২২ কবে? জামাই ষষ্ঠী কেন পালন করা হয়?
যে পরিবারে সদ্য বিবাহিতা কন্যা রয়েছে সেই পরিবারে এই পার্বণটি ঘটা করে পালন করা হয়।
জামাই ষষ্ঠী ২০২২ তারিখ ও সময়সূচি
বাংলা তারিখ | ইংরেজী তারিখ | দিন |
২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯ | ০৫ জুন ২০২২ | রবিবার |
জামাই ষষ্ঠী কেন পালন করা হয়?
আম-কাঁঠাল, ইলিশের পেটি কিংবা কচি পাঠাঁর মাংস সহযোগে ভুরিভোজ ৷ পঞ্চব্যঞ্জনে সাজনো জামাইয়ের পাত। জামাই ষষ্ঠীর কথা মনে এলে প্রথমেই চোখে ভেসে ওঠে এমন দৃশ্য। মা ষষ্ঠীর সঙ্গে জামাইয়ের সম্পর্কটা কী এ প্রশ্ন নিশ্চয় অনেকবার আপনার মনে এসেছে?
ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একসময় সংস্কার ছিল কন্যা যতদিন না পুত্রবতী হয় ততদিন কন্যার পিতা বা মাতা কন্যাগৃহে পদার্পণ করবেন না ৷ এই ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিল, সন্তানধারণে সমস্যা বা সন্তান মৃত্যুর (শিশুমৃত্যু) ফলে কন্যার পিতামাতাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত কন্যার বাড়ি যাওয়ার জন্য ৷ সেক্ষেত্রে বিবাহিত কন্যার মুখদর্শন কীভাবে ঘটে? তাই সমাজের বিধানদাতা জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীকে বেছে নিলেন জামাই ষষ্ঠী হিসাবে ৷ যেখানে মেয়ে জামাইকে নিমন্ত্রণ করে সমাদর করা হবে ও কন্যার মুখ দর্শন করা যাবে ৷
আর সেইসঙ্গে মা ষষ্ঠীর পুজো করে তাঁকে খুশি করা যাতে কন্যা শীঘ্র পুত্রমুখ দর্শন করতে পারে ৷ বর্তমানে অবশ্য এই সংস্কার পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে — কন্যার পিতামাতা অথবা যে ব্যক্তি কন্যা সম্প্রদান করবেন তিনি এক বৎসর কন্যার বাড়ি যাবেন না বা গেলেও কন্যার বাড়ির অন্নগ্রহণ করবেন না ৷
যদিও আধুনিক শহুরে জীবনে এই সংস্কার বিশেষ গুরুত্ব পায় না ৷ সংস্কার যাই হোক না কেন, মেয়ে জামাইকে ডেকে এনে সমাদর করা ও সেইসঙ্গে কন্যা যাতে সন্তানবতী হয় সেই লক্ষ্যে ‘মা ষষ্ঠীকে’ জুড়ে দিয়ে উৎসবের নামকরণ হল ‘জামাইষষ্ঠী’৷
আরো পড়ুনঃ ১৪২৯ সালের অন্নপ্রাশনের তারিখ ও সময়সূচী
ষষ্ঠী-পালন সাধারণত করে থাকেন মেয়েরা ৷ তাঁদের কাছে এর তাৎপর্য অন্যরকম ৷ কথিত আছে — এক পরিবারে দুটি বউ ছিল ৷ ছোট বউ ছিল খুব লোভী ৷ বাড়ির মাছ বা অন্যান্য ভাল খাবার রান্না হলেই সে লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে নিত আর শাশুড়ির কাছে অভিযোগ করত ‘সব কালো বেড়ালে খেয়ে নিয়েছে ’৷
বেড়াল মা ষষ্ঠীর বাহন ৷ তাই বেড়াল, মা ষষ্ঠীর কাছে অভিযোগ জানাল ৷ মা ষষ্ঠী রেগে গেলেন ৷ যার জেরে ছোট বউ-এর একটি করে সন্তান হয় আর মা ষষ্ঠী তার প্রাণ হরণ করেন ৷ এইভাবে ছোট বউয়ের সাত পুত্র ও এক কন্যাকে মা ষষ্ঠী ফিরিয়ে নেন ৷ ফলে স্বামী, শাশুড়ি ও অন্যান্যরা মিলে তাকে ‘অলক্ষণা’ বলে গালিগালাজ করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় ৷ অথচ বড় বউ পুত্রকন্যাদের নিয়ে সুখে ঘর করতে থাকে ৷
আরো পড়ুনঃ ১৪২৯ সালের সাধভক্ষণের সঠিক তারিখ ও সময়সূচী
ছোট বউ মনের দুঃখে বনে চলে যান ও একাকী কাঁদতে থাকেন ৷ শেষে মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার ছদ্মবেশে তার কাছে এসে কান্নার কারণ জানতে চান ৷ সে তার দুঃখের কথা বলে ৷ তখন মা ষষ্ঠী তার পূর্বের অন্যায় আচরণের কথা বললে সে মাফ চায় ৷ ষষ্ঠী তাকে ক্ষমা করেন | এরপর বলেন — ভক্তিভরে ষষ্ঠীর পুজো করলে সাতপুত্র ও এক কন্যার জীবন ফিরে পাবে ৷ তখন ছোট বউ সংসারে ফিরে এসে ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করে ও ক্রমে ক্রমে তার পুত্র কন্যাদের ফিরে পায় ৷ এর থেকে দিকে দিকে ষষ্ঠী পুজোর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে ৷ এটাই জামাইষষ্ঠী বা অরণ্যষষ্ঠী ব্রতকথার মূল গল্প ৷
এদিকে যে সময় জামাই ষষ্ঠী পালন করা হয় অর্থাৎ জৈষ্ঠ্য মাসে, প্রকৃতিতে আম-জাম-কাঁঠাল ইত্যাদি নানা ফলের সমারোহ ৷ তাই খুব ঘটা করে এদিন শাশুড়িরা ষষ্ঠীর পূজা করেন ৷ তারপর নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসা জামাইকে আসনে বসিয়ে প্রথমে কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করেন ও দীর্ঘজীবন কামনায় মা ষষ্ঠীর স্মারক তেল-হলুদে চোবানো সুতো হাতের কবজিতে বেঁধে দেন ৷ এরপর আশীর্বাদী বস্ত্রাদি জামাইয়ের হাতে তুলে দেন ৷ আর সামনে বিবিধ মিষ্টান্নসহ নানা ফল খেতে দেন ৷ অবশ্য জামাই বাবাজীও শ্বশুরবাড়ি ঢোকার সময় যেমন দই-মিষ্টি আনতে ভোলে না তেমনি আশীর্বাদের পর প্রণামী হিসেবে শাশুড়িকে বস্ত্রাদি দিয়ে থাকে ৷ এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য —শুধুই জামাই নয়, মেয়েও কিন্তু বস্ত্রাদি উপহার হিসাবে পেয়ে থাকে ৷
জামাইষষ্ঠী একটি লোকায়ত প্রথা। ষষ্ঠীদেবীর পার্বণ থেকে এই প্রথার উদ্ভব। বৈদিক যুগ থেকেই জামাইষষ্ঠী পালন হয়ে আসছে। প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী তিথিতে প্রথম প্রহরে ষষ্ঠী পুজার আয়োজন করা হয়। ষষ্ঠীর প্রতিমা কিংবা আঁকা ছবিতে পুজা নিবেদন করা হয়। কেউ কেউ ঘট স্থাপন করেও এই পুজো করে থাকেন।
আরো পড়ুনঃ শিব প্রণাম মন্ত্র | শিব গায়ত্রী মন্ত্র | শিব ধ্যান মন্ত্র | শিবের সকল মন্ত্র
কথিত রয়েছে, একবার এক গৃহবধূ স্বামীর ঘরে নিজে মাছ চুরি করে খেয়ে দোষ দিয়েছিলেন বিড়ালের উপর। ফলে তাঁর সন্তান হারিয়ে যায়। তাঁর পাপের ফলেই এই ঘটনা ঘটে বলে মনে করা হয়। তখন সেই মহিলা বনে গিয়ে ষষ্ঠীদেবীর আরাধনা শুরু করেন৷ দেবী তুষ্ট হন৷ ফলে বনেই তিনি নিজের সন্তানকে ফিরে পান। এই জন্যই ষষ্ঠীদেবীর অপর নাম অরণ্যষষ্ঠী।
এদিকে মাছ চুরি করে খাওয়ার জন্য শ্বশুর-শাশুড়ি ওই বধূর পিতৃগৃহে যাওয়া বন্ধ করে দেন। এই অবস্থায় মেয়েকে দেখার জন্য ব্যাকুল মা-বাবা একবার ষষ্ঠীপুজোর দিন জামাইকে সাদরে নিমন্ত্রণ জানান। জামাইষষ্ঠী পুজোর দিনে সস্ত্রীক উপস্থিত হলে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় বাড়িতে। ষষ্ঠী পুজো রূপান্তরিত হয় জামাইষষ্ঠীতে।
বাঙালি হিন্দুসমাজে এ উৎসবের সামাজিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিশেষত যে পরিবারে সদ্য বিবাহিতা কন্যা রয়েছে সেই পরিবারে এই পার্বণটি ঘটা করে পালন করা হয়। পুজোর সময় পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য পৃথক মালসার মধ্যে নতুন বস্ত্র, ফলফলাদি, পান-সুপারি, ধান-দূর্বা ও তালের পাখা রাখা হয়। ভক্তরা উপোস রেখে মায়ের পূজা করেন। মালসা থেকে নতুন বস্ত্র পরিধান করে ফলফলাদি খেতে হয়।
আরো পড়ুনঃ ১৪২৯ শুভ বিবাহের তারিখ ও লগ্ন