কম্বোডিয়ায় হিন্দু ধর্ম
কম্বোডিয়ায় হিন্দু ধর্মের অস্তিত্বের প্রধান প্রমাণ আঙ্করভাট মন্দির। আঙ্করভাট কম্বোডিয়ার আংকরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মধ্যযুগীয় মন্দির।
কম্বোডিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ। দেশটি কাম্পুচিয়া নামেও পরিচিত। কম্বোডিয়ার উত্তর-পূর্বে লাওস, পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে ভিয়েতনাম, পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমে থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে থাইল্যান্ড উপসাগর। নম পেন দেশের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর।
প্রাচীনকাল থেকেই কম্বোডিয়াতে রাজতন্ত্র বিদ্যমান ছিল। এক হাজার বছরেরও আগে কম্বোডিয়া খমের জাতির আংকর সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল। আংকর সাম্রাজ্যটি ৬০০ বছর ধরে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে বিস্তৃত ছিল। ১৮৬৩ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এটি একটি ফরাসি প্রোটেক্টোরেট ছিল। ১৯৭০ সালে রাজতন্ত্রের স্থানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৯৭৫ সালে খমের রুজ নামের একটি সাম্যবাদী সরকার ক্ষমতা লাভ করে।
কম্বোডিয়ার ৯৮.২ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। তার মধ্যে ৮৬.১% থেরবাদী বৌদ্ধ , মহাযানী বৌদ্ধ ও ৪.১% বজ্রযানী বৌদ্ধ ।
বর্তমানে কম্বোডিয়া একটি বৌদ্ধ প্রধান দেশ হলেও, অতীতে কম্বোডিয়া ছিল একটি হিন্দু দেশ। এক হাজার বছরেরও আগে কম্বোডিয়া খমের জাতির আংকর সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল। আংকর সাম্রাজ্যটি ৬০০ বছর ধরে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে বিস্তৃত ছিল। খেমের সাম্রাজ্য ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি শক্তিশালী হিন্দু-বৌদ্ধ সাম্রাজ্য।
আরো পড়ুনঃ ১৪২৮ বৈশাখ মাসে বিয়ের শুভ দিন, তারিখ ও লগ্ন
ফুনান সাম্রাজ্যের সময়কালে কম্বোডিয়া প্রথম হিন্দু ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়। পরবর্তীতে খেমের সাম্রাজ্যেরও অন্যতম অফিসিয়াল ধর্ম ছিল হিন্দু ধর্ম। কম্বোডিয়ায় হিন্দু ধর্মের অস্তিত্বের প্রধান প্রমাণ আঙ্করভাট মন্দির। আঙ্করভাট কম্বোডিয়ার আংকরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মধ্যযুগীয় মন্দির। সুবিশাল এই স্থাপনাটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ মন্দির।
১২শ শতাব্দীতে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন রাজা ২য় সূর্যবর্মণ। তিনি এটিকে তার রাজধানী ও প্রধান উপাসনালয় হিসাবে তৈরি করেন। তখন থেকেই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান হিসাবে বিবেচিত। এই মন্দিরের আরাধ্য দেবতা ছিলেন বিষ্ণু। পরবর্তীকালে এই মন্দিরটিকে বৌদ্ধ মন্দিরে রূপান্তরিত করা হয়।
আঙ্করভাটের নির্মাণশৈলী খেমের সাম্রাজ্যের স্থাপত্যকলার এক অনুপম নিদর্শন। কম্বোডিয়ার জাতীয় পতাকায় আঙ্করভাট মন্দির স্থান পেয়েছে। কম্বোডিয়ার প্রধান পর্যটন আকর্ষণ আঙ্করভাট।
আরো পড়ুনঃ মুসলিম দেশ ইয়েমেনে হিন্দু ধর্ম
আঙ্করভাট সবচেয়ে বড় মন্দির হলেও সমগ্র আঙ্কর জুড়েই রয়েছে অসংখ্য মন্দির। আঙ্কর শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে, যার অর্থ হলো নগর। অর্থাৎ এটি মন্দিরের শহর। এই মন্দিরগুলোর বেশীরভাগই ছিল হিন্দু মন্দির।আঙ্করভাট এবং তাঁর পার্শ্ববর্তী মন্দিরের বেশীরভাগই শিবের মন্দির।
হিন্দুধর্মে তিনজন প্রধান দেবতা আছেন, যারা হলেন- শিব, বিষ্ণু এবং ব্রহ্মা। এর মধ্যে বিষ্ণু ‘রক্ষক’ বা ‘প্রতিপালক’ হিসেবে পরিচিত। তার প্রতি উৎসর্গ করেই উক্ত মন্দিরটি নির্মিত হয়। মন্দিরটি নির্মাণের পেছনে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব ছিল সম্রাট দ্বিতীয় সূর্যভার্মানের, যার নামের অর্থ সূর্যের রক্ষক। অনেকের মতে, অ্যাঙ্কর ওয়াট শুধু দেবতার প্রতি উৎসর্গের জন্যই নয়, বরং সম্রাটের সমাধিস্তম্ভ হিসেবে ব্যবহারের জন্যও নির্মিত হয়।
সম্রাট দ্বিতীয় সূর্যভার্মান ছিলেন খুব ধার্মিক, দেবতা বিষ্ণুর পরম ভক্ত। সর্বদাই তিনি বিষ্ণুদেবের পূজা করতেন এবং অ্যাঙ্কর ওয়াটের কেন্দ্রীয় মিনারে তাঁর একটি মূর্তিও সম্রাটের আদেশে স্থাপন করা হয়। মন্দিরটির প্রত্যেক অংশে তার ভক্তির নিদর্শন দেখা যায়। সম্রাট সূর্যভার্মানকে তার মৃত্যুর পর এই ভক্তির জন্য ‘পরমবিষ্ণুলোক’ উপাধি দেওয়া হয়। এর অর্থ হলো ‘সেই ব্যক্তি যে বিষ্ণু দেবের সর্বোত্তম গৃহে বাস করে’।
আরো পড়ুনঃ ১২ জন হিন্দু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনে নিয়োগ পেয়েছেন!
পুরাতত্ত্ববিদ চার্লস হিগাম এখানকার কেন্দ্রীয় টাওয়ারে একটি কলসী জাতীয় বস্তু পেয়েছেন, যা সম্ভবত অন্তেষ্টিক্রিয়ার সময় চিতাভস্ম রাখার জন্য ব্যবহার করা হত। সাধারণত মন্দিরের অবস্থান পূর্বদিকে মুখ করা থাকলেও অ্যাঙ্কর ওয়াট পশ্চিম দিকে মুখ করে অবস্থিত।
বিশেষজ্ঞরা এজন্য বিভিন্ন যুক্তি ও ব্যাখা দিয়েছেন। হিন্দু ধর্ম মতে, বিষ্ণু হলেন সকল দেবতা হতে সবচেয়ে উত্তম এবং তিনি তাদের সামনে অবস্থান করেন। বাকি দেবতাদের অবস্থান যেহেতু পূর্বে এবং উক্ত মন্দিরটি বিষ্ণুদেবের জন্যই নির্মিত, সেহেতু তার উদ্দেশ্যেই এই মন্দিরের অবস্থান এরকম।
আবার হিন্দু ধর্মানুসারে, পূর্বদিকের সাথে মৃত্যুর বিষয়টিও জড়িত। সূর্যভার্মান যখন প্রথম এর নির্মাণকাজ শুরু করেন, তখন তিনি তার সমাধি তৈরির নির্দেশও দেন। হয়তো তার বিশ্বাস ছিল, পূর্বমুখী না হয়ে তার সমাধি যদি পশ্চিমমুখী হয়, তাহলে তার অমর হওয়ার বা পরপারেও রাজত্ব করার সুযোগ থাকবে।
১১১৬ সালে রাজা সূর্যভার্মান সিংহাসনে আসলে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। এই কাজের সমাপ্তি ঘটে ১১৫০ সালে, রাজা সূর্যভার্মানের মৃত্যুরও অনেক পরে। খেমার সম্রাটেরা নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব পোক্ত করার জন্য এবং তাদের উপর দেবতাদের আশীর্বাদ রয়েছে তা বোঝানোর জন্য মন্দিরের বেশ কয়েকটি ভবন নির্মাণ করেন।
আরো পড়ুনঃ মুসলিম দেশ ইরানে হিন্দু ধর্ম
হিন্দু মন্দিরগুলো শুধু ধর্মীয় উপসনালয় হিসেবেই নয়, একই সাথে দেবতাদের গৃহ হিসেবেও ব্যাখা করা হয়। কম্বোডিয়ার সম্রাটেরা আরেকটি বিশ্বাস সবার মধ্যে জাগ্রত করতে চান। তার পূর্বসূরী কিংবা তার শত্রুদের উপর নয়, বরং তার উপর যে দেবতারা বেশি সন্তুষ্ট তা বোঝাতেই সব রাজাই পূর্বের সম্রাটের তুলনায় অধিক চমৎকার মন্দিরের ভবন গঠনের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।
কম্বোডিয়ায় এই মন্দিরটি এতটাই সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় যে, এই দেশের জাতীয় পতাকায় এই অ্যাঙ্কর ওয়াট চিত্রিত রয়েছে। দেশটির প্রধান পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে একটি হলো এই মন্দিরটি। এমনকি ১৯৯২ সালে এটি ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে স্বীকৃতিও পায়।
অতি সাম্প্রতিককালে ইন্দোনেশিয়ায় হিন্দুদের আগমন ঘটে ৬০-৭০ এর দশকে। বিশেষ করে ভারতের তামিলনাড়ু থেকে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এখানে এসেছিলেন। ১৯৬৮ সালে খেমার রুজ শাসন শুরু হলে বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেশীরভাগ ভারতীয় কম্বোডিয়া ত্যাগ করে। তাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ বিবেচনায় কম্বোডিয়ায় ভারতীয় হিন্দুদের সংখ্যা একদম নগণ্য।
আরো পড়ুনঃ ২০২১ সালের অমাবস্যার সঠিক তিথি ও সময়সূচী!
বর্তমানে ৫ হাজারের মতো ভারতীয় হিন্দু কম্বোডিয়ায় বসবাস করছেন। সংখ্যায় কম হলেও হিন্দুরা দিওয়ালী ও হোলির মতো উৎসব বেশ ধুমধাম করে পালন করেন। এছাড়া বেশ কয়েকটি ভারতীয় হিন্দু মন্দিরও রয়েছে কম্বোডিয়াতে।