রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে যেভাবে শ্রীলঙ্কায় টিকে আছে হিন্দু ধর্ম!
ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপ দেশ হচ্ছে শ্রীলঙ্কা, যার অস্তিত্তের কথা পাওয়া যায় আমাদের রামায়ণে। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংবলিত সমুদ্রসৈকত, ভূদৃশ্য তদুপরী সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শ্রীলঙ্কাকে সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছে। শ্রীলংকার জনসংখ্যা দুই কোটির একটু বেশী।
রামায়ণের -লঙ্কা কাণ্ডে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মাঝে যে রাম-সেতুর কথা উল্লেখ আছে সম্প্রতি আর্কিওলজিস্টরা স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে তার অস্তিত্তের প্রমান পেয়েছেন। এই শ্রীলঙ্কাতে সর্ব-প্রথম সনাতন ধর্মের পদচিহ্ন পড়ে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০ শতকে, যখন তৎকালীন ভারতবর্ষ থেকে বিজয় নামে একজন আর্য তার ৭০০ অনুসারী নিয়ে সেখানে গমন করেন। বিজয় ছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রথম রাজা।
অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এই বিজয়ের আদি নিবাস ছিল আজকের পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার সিঙ্গুরে । পরবর্তীতে নানা সময়ে ভারতবর্ষ থেকে নানা সময়ে হিন্দুরা সেখানে যান এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ হিন্দুই জাতিগত ভাবে তামিল সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত এবং অধিকাংশ তামিল শ্রীলংকাতে আসে উপমহাদেশের ব্রিটিশ শাসনামলে শ্রমিক হয়ে।
শ্রীলংকার ৭৪.৯ শতাংশ সিংহলী, ১৫.৪ শতাংশ তামিল এবং ৯.২ শতাংশ মুর জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। শ্রীলংকা মূলত বৌদ্ধ প্রধান দেশ। শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যার ৭০.২ শতাংশ বৌদ্ধ ও ১২.৬ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বর্তমানে হিন্দুরা শ্রীলঙ্কার ২য় বৃহত্তম ধর্ম। ২০১২ সালের তথ্য অনুযায়ী শ্রীলংকাতে বসবাসরত হিন্দু জনসংখ্যা ২৫ লক্ষের কিছু বেশী। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মত শ্রীলঙ্কাতেও হিন্দু জনসংখ্যা কমছে । ১৭ শতকে পর্তুগিজ ও পরে ব্রিটিশরা শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার একটি অংশকে জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে, যার মধ্যে একটি বড় অংশই ছিল হিন্দু তামিল শ্রমিকরা।
আরো পড়ুনঃ নেপাল কি এখনো হিন্দুরাষ্ট্র? নেপালে হিন্দু ধর্মের ইতিহাস
তবে প্রধান কারণ কয়েক দশক ধরে চলে আসা সিংহলি ও তামিলদের মধ্যে জাতিগত সংঘাত। এই সংঘাত এর শুরু তামিলদের উপর সিংহলিদের আগ্রাসি মনোভাবের বিভিন্ন কর্মকান্ড থেকে। তামিলরা সংখ্যায় কম হলেও শুরু থেকেই তারা তাদের প্রখর মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির জোরে সবসময় সিংহলীদের থেকে এগিয়ে ছিল, যে কারনে একদিন শ্রমিক হয়ে আসা তামিল হিন্দুরা যখন দেশের বড় বড় ক্ষেত্রে অবদান রাখতে শুরু করল, তখনই সিংহলিদের জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। বিবিসি নিউজ এর তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সালে বিভিন্ন তামিল বিরোধী দাঙ্গায় শত শত তামিলকে হত্যা করা হয়, নিখোঁজ হয় কয়েক হাজার তামিল, রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু করা হয় তামিলদের প্রতি অসংখ্য বৈষম্যমূলক নীতি।
অবশেষে নির্যাতনে নিপীড়িত তামিলরা নিজেদের অস্তিত্তের জন্য বেছে নেয় পাল্টা সংঘাত এর পথ। ১৯৭৬ সালে আলাদা তামিল রাষ্ট্রের দাবিতে সংগঠিত হয় ‘লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম বা LTTE’। সেই থেকে গৃহযুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে তামিলদের সাথে সিংহলি সরকারের সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য নিরীহ মানুষ। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপ্রধান মহিন্দর রাজপাকসে ভারতের কংগ্রেস সরকারের নীরব সমর্থনে LTTE এর উপর এক বড় সামরিক অভিযান শুরু করে, যাতে LTTE প্রধান প্রভাকরণ ভেলুপিল্লাই এর মৃত্যুর মাধ্যমে LTTE পরাজিত হয়। তবে LTTE না, শ্রীলংকা সরকারের আসল উদ্দেশ্য ছিল তামিলদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যে সত্য উলঙ্গভাবে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
আরো পড়ুনঃ হিন্দু ধর্ম যেভাবে ইতালির অন্যতম প্রধান ধর্ম হয়ে উঠলো!
আমেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন সহ অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান শ্রীলংকা সরকারকে এই যুদ্ধঅপরাধের সঠিক তদন্তপূর্বক শাস্তি দাবি করলেও শ্রীলঙ্কা সরকার তা অস্বীকার করে আসছে। তামিলদের উপর বুদ্ধের শান্তিপ্রিয় সৈনিকদের এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কানাডা, আমেরিকা, ব্রিটেন সহ বিভিন্ন দেশে এর প্রতিবাদ হয়েছে। উল্লেখ্য হিন্দুদের মধ্যে তামিলরা বিপুল সংখ্যায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রয়েছে আর তারা ধর্মের Ethnicity রক্ষার ব্যাপারে অনেক সচেতন।
The International Policy Digest শ্রীলঙ্কা সরকারের একটি গোপন নথি প্রকাশ করেছিল, যাতে দেখা যায়, রাজপাকসে সরকার তামিল অধ্যুষিত এলাকার সব মন্দির ও ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল এবং সে অনুযায়ী ৩৬৭ টি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল। যার মধ্যে শুধু জাফনাতেই ২০৮ টি মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। যাই হোক, এসবের পরেও শ্রীলঙ্কাতে এখনও বেশ কিছু প্রাচীন মন্দির রয়েছে যার মধ্যে ‘নাইনাতিভু নাগাপুশানি আম্মান মন্দির’ ও ‘নাল্লুর কান্ডস্বামী মন্দির উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি কলম্বোতে নির্মিত হয়েছে ‘পুনাবাল-বানেশ্বরম মন্দির’ নামে একটি বড় মন্দির।
এছাড়া শ্রীলঙ্কাতে তামিল হিন্দুদের অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার মধ্যে জাফনা হিন্দু কলেজ অন্যতম। আলোচিত হিন্দু ব্যক্তিত্বের মধ্যে রয়েছেন, কিংবদন্তী ক্রিকেটার মুথিয়া মুরালিধরণ, যিনি এখন পর্যন্ত টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শ্রীলঙ্কা সরকার তামিল হিন্দুদের কল্যাণে কিছু লোক দেখানো পদক্ষেপ নিলেও, তাদের আসল অবস্থার কোন উন্নতি হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই।