মন্দির

হংসেশ্বরী মন্দির – হুগলীর বাঁশবেড়িয়ার প্রাচীন ও রহস্যময় কালী মন্দির!

হংসেশ্বরী মন্দির পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার বাঁশবেড়িয়ায় অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির হলো। এই মন্দিরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে নানা অজানা কাহিনী। সনাতন পন্ডিতের আজকের প্রতিবেদন থেকে হংসেশ্বরী মন্দিরের অজানা কাহিনী নিয়ে আলোচনা করা হবে।

পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে গঙ্গা। জলের প্রবাহে রয়েছে ভাঙা-গড়ার কত কাহিনী। ১৭৯৯ সালে বংশবাটী রাজ-নৃসিংহদেব রায় হংসেশ্বরী মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু এই মন্দির নির্মাণের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর। রানি শঙ্করী দেবীর বলিষ্ঠ হস্তক্ষেপে কাজ শেষ হয় ১৮১৪ সালে। পদ্মের কুঁড়ির আদলে তেরো চূড়ায় সজ্জিত অভিনব মন্দির এবং তার গঠন শৈলী আজও মোহিত করে শিল্পরসিকদের। ষটচক্রভেদ যোগের আধারে নির্মিত। ষটচক্রভেদ প্রণালীতে তৈরি ত্রয়োদশ পদ্মকারক শোভিত চূড়াবিশিষ্ট এই মন্দিরের মধ্যে কুলকুণ্ডলিনী শক্তিরূপী মহামায়া, আদ্যাস্বরূপিণী হংসেশ্বরীর স্থাপনা।

হংসেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস
হংসেশ্বরী মন্দির

আরো পড়ুনঃ মতুয়া কারা? মতুয়া সম্প্রদায় কে গড়ে তোলেন?

এই মন্দিরে পুজোর বৈশিষ্ট্য হল, পুজোর দিন মা হংসেশ্বরীর মুখে মা কালীর একটি মুখোশ পরিয়ে দেওয়া হয়। যদিও পুজোর পরের দিন সেই মুখোশ খুলে নেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়ম মেনেই চলে আসছে মায়ের পুজো, আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

এই মন্দিরের চারপাশে রয়েছে পরিখা। যাকে চলতি কথায় বলা হয় গড়। সেখানে ঢোকার মুখে সুবিশাল নহবতখানা। সংস্কার আর বয়সের ভারে নহবতখানায় জীর্ণতার ছাপ স্পষ্ট। দেওয়াল থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। নহবতখানা থেকে কয়েক পা এগোলেই হংসেশ্বরী মায়ের মন্দির। ভিতরে হংসেশ্বরীর পঞ্চমুণ্ডির আসন। সহস্রদল পদ্মের উপর ত্রিকোণ বেদী। মহাদেবের হৃদয় থেকে দ্বাদশ পদ্মের উপর মায়ের অধিষ্ঠান। মায়ের বর্ণ নীল, মাথায় ঘোমটা। সারাবছর মায়ের শান্ত রূপ থাকে। তবে কার্তিক মাসের কালীপুজোয় একরাতের জন্য মায়ের রূপ হয় এলোকেশী।

হংসেশ্বরী কালী মন্দিরের পাশেই রয়েছে পোড়ামাটির কাজ সমৃদ্ধ অপূর্ব মন্দির ‘অনন্ত বাসুদেব’ মন্দির। ১৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন রামেশ্বর দত্তরায়। অনন্ত বাসুদেব মন্দিরটি হংসেশ্বরী মন্দিরের প্রায় একশো বছর আগে নির্মিত।

পোড়ামাটির কাজে সজ্জিত এই মন্দিরের আদল অনেকটা বিষ্ণুপুরের মন্দিরের মতো। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী নষ্ট হচ্ছে। অনন্তবাসুদেব মন্দিরের প্রাচীন কষ্টিপাথরের মূর্তি চুরি হয়ে যায় অনেক আগে। পুরো এলাকাটিই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের অধীন।

হংসেশ্বরী মন্দিরের ছবি
হংসেশ্বরী মন্দির সংলগ্ন ‘অনন্ত বাসুদেব মন্দির’

আরো পড়ুনঃ বৃন্দাবন ধামের অজানা ইতিহাস ও ভ্রমণ গাইড

রামেশ্বর দত্তরায়ের আদি বাড়ি বর্ধমানের অন্তর্গত পাটুলিতে। পরবর্তীকালে বংশবাটী তথা বর্তমান বাঁশবেড়িয়াতে রাজধানী স্থাপন করেন। রামেশ্বরের পুত্র রঘুদেব, রঘুদেবের পুত্র গোবিন্দদেব, গোবিন্দদেব আর হংসেশ্বরী দেবীর পুত্র নৃসিংহদেব। এই হংসেশ্বরী দেবীর নামেই বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির। নৃসিংহদেবই হংসেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠারম্ভ করেন।

গোবিন্দদেব মারা যাবার তিন মাস পর জন্ম হয় নৃসিংহদেবের। নিজ পিতৃসম্পত্তি উদ্ধারের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন রাজা নৃসিংহদেব তাঁর মা হংসেশ্বরী দেবীর কাছে। তাই ১৭৯২ খ্রীষ্টাব্দে নৃসিংহদেব পিতৃসম্পত্তি উদ্ধারের জন্যে অর্থ উপার্জনের হেতু কাশী যাত্রা করেন। কাশীতে থাকাকালীন একদিন রাতে মাতৃরূপে দৈব দর্শন হল রাজা নৃসিংহদেবের। তিনি তাঁর মা হংসেশ্বরী দেবীকে দেখলেন এক জগজ্জননী মাতৃরূপে। পরের দিনই তিনি স্থির করলেন, রাজকোষে জমা টাকা দিয়ে তিনি আর কিছু না, বংশবাটীতে একটি মন্দির তৈরি করবেন, এক মাতৃমন্দির, মা হংসেশ্বরী দেবীর মন্দির।

সংসার তো ত্যাগ করেছিলেন অনেক দিন আগেই, এখন তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। জীবনের লক্ষ্য পাল্টে যায় তাঁর। ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ফিরলেন কাশী থেকে। ক্রয় করে আনলেন সাত নৌকা চুনা-পাথর, মন্দির তৈরির জন্যে। উত্তরখণ্ড থেকে আনা হয় প্রস্তর শিল্পী। কিন্তু ১৮০২ খ্রীষ্টাব্দে মন্দির অসমাপ্ত রেখেই ভবলীলা সাঙ্গ করে বিদায় নেন সন্ন্যাসী নৃসিংহদেব।

হংসেশ্বরী মন্দির বাঁশবেড়িয়া
হংসেশ্বরী মায়ের মূর্তি

আরো পড়ুনঃ নেপালের এই জায়গায় এখনো দেখা যায় ভগবান কৃষ্ণের পায়ের ছাপ!

হংসেশ্বরী মন্দিরটি তৈরিতে নৃসিংহদেবের থেকে অনেক বেশি ভূমিকা ছিল তাঁর ছোটরানি শঙ্করী দেবীর। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শঙ্করী দেবী বহু বাধা, বহু প্রতিবন্ধকতার সাথে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেন। এমনকি নৃসিংহদেবের এক পালিত পুত্র কৈলাসদেবের সাথে জমি জমা সংক্রান্ত মামলায় পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু শঙ্করী দেবীর জীবনের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, ওনার স্বামীর স্বপ্ন সম্পূর্ণ করা। অবশেষে ১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দে সমাপ্ত করেন হংসেশ্বরী মন্দির নির্মাণ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!