তীর্থস্থানমন্দির

বৃন্দাবন ধামের অজানা ইতিহাস ও ভ্রমণ গাইড

হিন্দু ধর্মের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে বৃন্দাবন নামটি অতি প্রাচীনকাল থেকে জড়িয়ে রয়েছে। সনাতন ধর্মানুসারীদের নিকট বৃন্দাবন অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান।

বৃন্দাবনের ইতিহাস

বৃন্দাবন হিন্দু ধর্মের পবিত্র তীর্থস্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি তীর্থস্থান। প্রায় প্রত্যেক সনাতন ধর্মানুসারীর তীর্থ ভ্রমণ আকাঙ্খার তালিকায় সর্বাগ্রে থাকে বৃন্দাবনের নাম। বৃন্দাবন আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, উভয়েই একে-অপরের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। বৃন্দাবনেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার বাল্যলীলা অতিবাহিত করেছেন।

বৃন্দাবন ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মথুরা জেলার অন্তর্গত একটি শহর। শহরটি কৃষ্ণের জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত মথুরা জেলা সদর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে ২নং জাতীয় সড়ক আগ্রা-দিল্লি হাইওয়ের উপর অবস্থিত। বর্তমানে বৃন্দাবন শহরে রাধা ও কৃষ্ণের অসংখ্য মন্দির রয়েছে।

বৃন্দাবন নামের উৎপত্তি কীভাবে?

সংস্কৃত বৃন্দাবন শব্দটি এসেছে বৃন্দা অর্থাৎ ‘তুলসী’ ও বন অর্থাৎ ‘অরণ্য’ শব্দ দুটি থেকে। বৃন্দাবনের নিধিবন ও সেবাকুঞ্জে এখনও দুটি তুলসী বন বিদ্যমান রয়েছে।

বৃন্দাবনের ইতিহাস

হিন্দু ধর্মের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে বৃন্দাবন নামটি অতি প্রাচীনকাল থেকে জড়িয়ে রয়েছে। সনাতন ধর্মানুসারীদের নিকট বৃন্দাবন অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান। বৃন্দাবনের প্রাচীন মন্দিরগুলোর মধ্যে একটি হলো গোবিন্দদেব মন্দির। ১৫৯০ সালে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই শতকেরই শুরুর দিকে বৃন্দাবন একটি শহর হিসেবে গড়ে ওঠে।

ষোড়শ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বর্তমান বৃন্দাবন আবিষ্কারের আগে মানুষ ভুলে গিয়েছিল বৃন্দাবনের আদি অবস্থান কোথায়! ১৫১৫ সালে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার স্থানগুলি নির্ধারণের লক্ষ্যে শ্রীচৈতন্য বৃন্দাবনে আগমণ করেন। প্রচলিত বিশ্বাস মতে, তিনি তাঁর দৈব ও আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে বৃন্দাবন ও তৎসংলগ্ন যে সব স্থানে কৃষ্ণ বাল্যলীলা করেছিলেন, সেগুলি আবিষ্কার করেন।

গত আড়াইশো বছরে বৃন্দাবন ক্রমেই গ্রামীন জনপদ থেকে একটি শহুরে জনপদে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এই অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বৃন্দাবনের অধিকাংশ বন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সেই সাথে বিলুপ্ত হয়ে গেছে স্থানীয় ময়ূর, ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। তবে গরু ও বানর এখনও বৃন্দাবনের সর্বত্র দেখা যায়।

আরো পড়ুনঃ কৃষ্ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করার পরে শ্রীরাধার কী হয়েছিল? কৃষ্ণ কী রাধাকে বিয়ে করেছিলেন?

বৃন্দাবনের জনসংখ্যা

২০১১ সালের সর্বশেষ জনগণনা অনুসারে, বৃন্দাবনের জনসংখ্যা ৫৬,৬১৮। জনসংখ্যা্র ৫৬% পুরুষ ও ৪৪% নারী। বৃন্দাবনের সাক্ষরতার গড় হার ৬৫%, যা ভারতের জাতীয় গড় হার ৭৪.০৪%-এর কম। বৃন্দাবনের জনসংখ্যার ১৩%-এর বয়স ৬ বছরের নিচে।

বৃন্দাবনের ধর্মীয় ঐতিহ্য

সনাতন ধর্মের বৈষ্ণবীয় ধারার অনুসারীদের কাছে বৃন্দাবন অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান। সারা বিশ্বের অসংখ্য কৃষ্ণ ভক্ত প্রতি বছর বৃন্দাবন ধাম দর্শনে আসেন এবং বিভিন্ন উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। ভাগবত পুরাণ অনুসারে, শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার প্রায় পুরোটা সময়ই বৃন্দাবনে কাটিয়েছেন। এখানেই কৃষ্ণ ও তাঁর দাদা বলরাম অন্যান্য রাখাল বালকদের সাথে দুষ্টুমি করে বেড়াতেন।

বৃন্দাবনকে ‘বিধবার নগরী’ নামেও অভিহিত করা হয়। এই অঞ্চলে প্রায় বিশ হাজারের মতো বিধবা বসবাস করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর অনেক সংখ্যক বিধবা নারী বৃন্দাবন ও এর কাছাকাছি অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। বিধবারা ভজনাশ্রমগুলিতে ভজন গেয়ে সময় কাটান।

আরো পড়ুনঃ শ্রীকৃষ্ণ জীবনের সব থেকে বড় অন্যায় কোন কাজটি করেছিলেন?

বৃন্দাবনের মন্দির

সমগ্র বৃন্দাবন জুড়ে রয়েছে অসংখ্য মন্দির। ভক্তদের পদচারণায় এই মন্দিরগুলো প্রতিদিন মুখরিত থাকে। দেখে নেয়া যাক বৃন্দাবনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মন্দিরের বর্ণনা।

মদনমোহন মন্দির

মদনমোহন মন্দির বৃন্দাবনের প্রাচীন মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম। জনশ্রুতি আছে যে, মুলতানের রাজা কাপুর রাম দাস কালীয় দমন ঘাটের কাছে মদনমোহন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনের সাথে এই মন্দির ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে এই মন্দিরের আদি মদনগোপাল বিগ্রহটি নিরাপত্তাজনিত কারণে রাজস্থানের কারাউলিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। বর্তমানে মদনমোহন মন্দিরে আদি বিগ্রহের একটি প্রতিমূর্তি পূজিত হয়।

মীরাবাঈ মন্দির

মীরাবাঈ ছিলেন একজন রাজপুত রাজকুমারী। তিনি অধুনা ভারতের রাজস্থান রাজ্যের নাগৌর জেলার অন্তঃপাতী মেরতার নিকটবর্তী কুদকি (কুরকি) নামে একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শৈশবে মীরাবাঈ এক সন্ন্যাসী দ্বারা পূজিত একটি কৃষ্ণমূর্তিত প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। মূর্তিটি নিজের করে নেয়ার জন্য তিনি প্রবল কান্না শুরু করেন। অবশেষে তাঁকে মূর্তিটি দেয়া হয়েছিল।

মীরাবাঈ তাঁর রাজ্য ও সংসার ত্যাগ করে জীবনের শেষ ১৪ বছর বৃন্দাবনে কাটান। যে মন্দিরে তিনি ছিলেন সেটি এখন মীরাবাঈ মন্দির নামে পরিচিত। নিধিবনের কাছে শাহপজি মন্দিরের দক্ষিণ দিকে মীরাবাঈ মন্দিরটি অবস্থিত। কৃষ্ণভক্ত মীরাবাঈ রচিত ভজনগুলো তাঁকে ভক্তি আন্দোলন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্ত কবির মর্যাদা দিয়েছিল।

বাঁকেবিহারী মন্দির

নিধিবন থেকে স্বামী হরিদাস বাঁকেবিহারীর বিগ্রহ আবিষ্কারের পর ১৮৬২ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাধাবল্লভ মন্দির

হরিবংশ মহাপ্রভু এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এই মন্দিরের বেদীতে শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহের পাশাপাশি শ্রীরাধার একটি মুকুট রাখা আছে।

প্রেম মন্দির

কৃপালু মহারাজ বৃন্দাবনের উপকণ্ঠে ৫৪ একর জমির উপর এই মন্দির নির্মাণ করেন। মূল মন্দিরটি শ্বেত পাথরে নির্মিত এবং সেখানে শ্রীকৃষ্ণের অসংখ্য খোদাই করা মূর্তি রয়েছে। রাতের বেলায় আলোর কারুকার্যে এই মন্দিরের রঙ বদলে যায়।

জয়পুর মন্দির

জয়পুরের মহারাজা দ্বিতীয় সাওয়াই মাধো সিং ১৯১৭ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। জয়পুরের মহারাজা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বলে এই মন্দিরকে জয়পুর মন্দির নামে ডাকা হয়।

শাহজি মন্দির

অনিন্দ্য-সুন্দর স্থাপত্যশৈলী ও শ্বেতপাথরের সুন্দর ভাস্কর্যের জন্য এই মন্দিরটি বিখ্যাত। ১৮৭৬ সালে লখনউয়ের শাহ কুন্দন লাল এই মন্দিরের নকশা করেন এবং মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। শাহজি মন্দিরে ১২টি সর্পিল স্বম্ভ রয়েছে। প্রতিটি স্তম্ভের উচ্চতা পনেরো ফুট। এছাড়া মন্দিরে অয়েল পেইন্টিং ও বেলজিয়াম কাঁচের ঝাড়বাতি সমন্বিত একটি হলঘর আছে।

রাধারমণ মন্দির

গোপাল ভট্ট গোস্বামীর অনুরোধে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। রাধারমণ মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের একটি শালগ্রাম বিগ্রহ রয়েছে।

বৃন্দাবনের অন্যতম একটি রহস্যময় স্থান নিধিবন। এই নিধিবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই লেখাটি দেখুন।

বৃন্দাবন কীভাবে যাবেন?

ট্রেন

1. হাওড়া থেকে প্রতিদিন পাবেন 12307 HWH JU EXP, ট্রেনটি প্রতিদিন রাত্রি 23:40 হাওড়া থেকে ছেড়ে পরেরদিন রাত্রি 19:45 আগ্রা ফোর্ট স্টেশন পৌঁছায়.

2. 12938 GARBHA EXP শুধুমাত্র সোমবার রাত্রি 23:00 টা হাওড়া থেকে ছেড়ে আগ্রা ফোর্ট পৌঁছায় পরেরদিন সন্ধ্যা 17:55

3. 12496 PRATAP EXP শুধুমাত্র শুক্রবার রাত্রি 22:45টা কলকাতা থেকে ছেড়ে আগ্রা ফোর্ট পৌঁছায় পরেরদিন সন্ধ্যা 17:55

4. 12938 ANNANYA EXP শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার দুপুর 13:10 কলকাতা থেকে ছেড়ে আগ্রা ফোর্ট পৌঁছায় পরেরদিন সকাল 10:25 এ.

বাসে

আগ্রার দুটি বাসস্ট্যান্ড ঈদগাহ এবং আগ্রা ফোর্ট থেকে আধ ঘণ্টা থেকে একঘণ্টা অন্তর ছাড়ে দিল্লির বাস। এই বাসে দেড় ঘণ্টার মধ্যে বৃন্দাবন পৌঁছে যাবেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!