মন্দির

উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বিখ্যাত ৮টি কৃষ্ণ মন্দির দর্শন করুন

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সনাতন ধর্মানুসারীদের নিকট অত্যন্ত আদরণীয় ও পূজনীয়। ভারতবর্ষসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য কৃষ্ণ মন্দির। সনাতন পন্ডিতের আজকের আয়োজন থেকে আমরা জানবো, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের ৮টি কৃষ্ণ মন্দির সম্পর্কে নানা অজানা তথ্য।

৮. কেশব দেও মন্দির

কেশব দেও মন্দির
কেশব দেও মন্দির

শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরা। সেখানে কংসের কারাগারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কেশব দেও মন্দিরটি কৃষ্ণের জন্মস্থানের ঠিক পাশেই অবস্থিত। কথিত আছে এই মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের মূল মূর্তিটি স্থাপন করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র শ্রীবজ্রনাভ। সুতরাং কাল বিবেচনায় এটি খুবই পুরোনো একটি মন্দির।

প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের এই মন্দিরটি। পরবর্তী কালে গুপ্ত সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত খ্রীস্টিয় ৪০০ অব্দে এখানে আরও একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই মন্দিরটি ১০১৭ সালে সুলতান মামুদ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।

তৃতীয়বার এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন জাজ্জা বিক্রম সাম্ভাত। সময়টা ছিল ১২০৭ সাল। তখন বিজয় পাল দেবের শাসনকাল। এই মন্দিরটি আবার ধ্বংস হয়ে যায় সিকান্দার লোদির হাতে। তবে এই ধ্বংসের আগে শ্রীচৈতন্য দেব এই মন্দিরটি দর্শন করেছিলেন।

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকালে আবারও মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। ১৬৬৯ সালে চতুর্থবার নির্মিত মন্দিরটি ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। ১৬৬৯ সালে মন্দিরটির স্থানে একটি ইদগাহ নির্মিত হয়।

এর পর ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ আমলে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি স্থানটি নিলামের আয়োজন করে। তখন কাশীর রাজা পান্তিমল জায়গাটি কিনে নেন। কিন্তু তিনি স্থানীয় মুসলিমদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। ঘটনাটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অবশেষে আদালত রাজার পক্ষে রায় দেয়। মন্দির তৈরির ইচ্ছা থাকলেও তা পূরণ করে যেতে পারেননি তিনি। ১৯৪৪ সালে মদন মোহন মালভ্য নামের এক জন ব্যক্তি কাশীরাজার উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে জায়গাটি কিনে নেন। মদন মোহন মালভ্যও মন্দিরটি দেখে যেতে পারেননি।

শেষ পর্যন্ত বিড়লা কোম্পানি ও ডালমিয়া গ্রুপের হাত ধরে ১৯৬৫ সালে আবার এই ঐতিহাসিক মন্দিরটি অবয়ব পায়। মন্দিরের পাশেই একটি জেল খানার মতো ছোট্টো একটি ঘর আছে। শ্রীকৃষ্ণের জন্মগ্রহণের সেই কারাগারের স্মরণে এই ঘরটি নির্মাণ করা হয়। এই কারাগার নির্মাণের কাজ শেষ হয় ১৯৮২ সালে।

০৭. রাধারমণ মন্দির

রাধারমণ মন্দির বৃন্দাবন
রাধারমণ মন্দির, বৃন্দাবন

১৫৪২ সালের বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মন্দির তৈরি করেছিলেন গোপাল ভট্ট গোস্বামী। গোপাল ভট্ট গোস্বামী হলেন ষড় গোস্বামীর একজন। তিনি মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যকে কঠোর ভাবে অনুসরণ করতেন। এই রাধারমণ মন্দির হল বৃন্দাবনের সর্বাধিক পূজিত ও জনপ্রিয় একটি মন্দির।

এই মন্দিরে স্বয়ম্ভু শালগ্রাম শিলায় শ্রীকৃষ্ণের একটি মূর্তি রয়েছে। এই মূর্তিটি এক ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট। এই মন্দিরে শ্রীরাধার কোনো মূর্তি নেই। শাস্ত্র অনুযায়ী নাম আর ব্যক্তি অভিন্ন। সেই কথা মেনে এখানে রাধারানির নাম পূজিত হন। শ্রীকৃষ্ণের মূর্তির পাশে একটি সোনার থালায় রাধারানির নাম খোদিত আছে। সেই নামই পুজো করা হয়। তবে বর্তমানে মন্দিরটির যে চেহারা তা স্থাপিত হয়েছে ১৮২৬ সালে। সেটি তৈরি করেছেন লখনউয়ের শাহ বিহারী লালজি। খরচ হয়েছিল ৮০ হাজার টাকা।

০৬. যুগল কিশোর মন্দির

যুগল কিশোর মন্দির বৃন্দাবন
যুগল কিশোর মন্দির, বৃন্দাবন

১৬২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই যুগলকিশোর মন্দির। উত্তরপ্রদেশের বৃন্দাবনে অবস্থিত এই মন্দিরটি, এই অঞ্চলের প্রাচীন একটি মন্দির। ১৫৭০ সালে মুঘল সম্রাট আকবর একবার এই স্থানে ভ্রমণ করতে এসেছিলেন। তিনি স্থান পরিদর্শন করে এখানে চারটি মন্দির স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন। তারই মধ্যে একটি যুগল কিশোর।

এই মন্দিরটি স্থাপন করেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী নদীর এই পারে এখানেই ভগবানের লীলা প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি এই ঘাটে কাশি রাক্ষসকে বধ করেছিলেন। তাই এই মন্দির ‘কাশীঘাট মন্দির’ নামেও পরিচিত।

০৫. রঙ্গোজি মন্দির

রঙ্গোজি মন্দির বৃন্দাবন
রঙ্গোজি মন্দির, বৃন্দাবন

‘রঙ্গোনাথ’ বা রঙ্গোজি মন্দির নামে পরিচিত বৃন্দাবনের এই মন্দিরটি। এটি অবস্থিত মথুরায়। ১৮৫১ সালে স্থাপিত হয়েছিল এই মন্দিরটি। উত্তর ভারতে দক্ষিণ ভারতের শিল্পকর্মের নির্দশন হিসাবেও এই মন্দিরটি বিখ্যাত। এটিতে রয়েছে দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্য কর্মের নিদর্শন। এখানে বিষ্ণুর রঙ্গোনাথ রূপটি পূজিত হয়।

এখানে শ্রীকৃষ্ণ অনন্তশায়ী রূপে অবস্থিত। এখানে একটি ছয় তলা গোপুরম ও ৫০ উঁচু ধ্বজাস্তম্ভ রয়েছে।

০৪. বাঁকে বিহারী মন্দির

বাঁকে বিহারী মন্দির বৃন্দাবন
বাঁকে বিহারী মন্দির, বৃন্দাবন

উত্তরপ্রদেশের মথুরায় অবস্থিত বাঁকে বিহারী মন্দির। এই মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের ত্রিভঙ্গ রূপ পূজিত হয়। দেবপারা যুগে স্বামী হরিদাস এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মন্দিরটির স্থাপত্য কর্ম রাজস্থানী ধরনের। তবে নতুন মন্দিরটি ১৮৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মন্দিরটির উচ্চতা ৫৫৭ ফুট।

০৩. মদন মোহন মন্দির

মদন মোহন মন্দির বৃন্দাবন
মদন মোহন মন্দির, বৃন্দাবন

বৃন্দাবনের আরও একটি বিখ্যাত মন্দির শ্রী মদন মোহন মন্দির। কাপুর রাম দাস এই মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন। সময়টা ছিল ১৫৮০ সাল। বৃন্দাবনের প্রাচীন মন্দিরগুলির মধ্যে একটি এই মদন মোহন মন্দির। এর আসল নাম হল ‘মদন গোপাল মন্দির’।

এই মন্দিরটির উচ্চতা ৬০ ফুট। এই মন্দিরটি দেবদাসাদিত্য নামের ৫০ ফুটের একটি টিলার ওপর অবস্থিত। সনাতন গোস্বামীর অনুরোধেই রাম দাস কাপুর এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। এটি বৃন্দাবনে স্থাপিত প্রথম মন্দির। এই সময় গোটা বৃন্দাবন একটি জঙ্গল ছিল। এই মন্দিতে রাধারানী, মদন মোহন ও ললিতা সখীর পুজো হয়।

০২. নিধিবন

নিধিবন
নিধিবন

এটি কোনো মন্দির নয়। বৃন্দাবনে অবস্থিত একটি পবিত্র বন। এখানে রয়েছে অসংখ্য নিধি অর্থাৎ তুলসী গাছ। কথিত আছে তুলসী ছিলেন কৃষ্ণের ভক্ত। সেই তুলসীবনে প্রতিরাতে রাধারানী আর গোপিনী সখীদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ রাসলীলা করতে আসতেন। এখনও নাকি প্রতি রাতে তাঁরা এখানে বিরাজ করেন। তাই প্রতিদিনই রাত নামলে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ এই নিধিবনে। কারণ দেব দর্শন পাওয়ার লোভে এই বনে থেকে লেগে আর জীবিত থাকেন না সাধারণ মানুষ।

এই বনের মন্দিরে সারাদিন ভক্তরা ভজন পুজন করেন। কিন্তু রাত নামলেই পান সুপারি দিয়ে এই স্থান ছেড়ে দরজা বন্ধ করে চলে যান। পরের দিন সকালে এই পানসুপারি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কৃষ্ণভক্তদের কাছে বৃন্দাবনে অবস্থিত এই নিধিবনের মাহাত্ম্য কোনো মন্দিরের থেকে কোনো অংশে কম নয়।

০১. দ্বারকাধীশ মন্দির

দ্বারকাধীশ মন্দির
দ্বারকাধীশ মন্দির, গুজরাট

মথুরায় জন্ম আর বৃন্দাবনে বড়ো হয়ে ওঠা। আবার মথুরায় গিয়ে কংস বধ। এরপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চলে গিয়েছিলেন দ্বারকায়। সেখানে তিনি প্রজাপালন করেছিলেন রাজা হিসাবে। তিনি ‘দ্বারকাধীশ’ বা ‘দ্বারকার রাজা’ নামে পরিচিত ছিলেন। সেই দ্বারকাতেই রয়েছে এই দ্বারকাধীশ মন্দির। এটি ‘জগত মন্দির’ বা ‘নিজ মন্দির’ নামেও সুপরিচিত। এটি অবস্থিত গুজরাটের দ্বারকায়। এটি একটি পাঁচতলা বাড়ি। এই বাড়িতে রয়েছে ৭২টি স্তম্ভ।

আর্কোলজিক্যাল তথ্য অনুযায়ী এই পাঁচতলা বাড়ি তথা মন্দিরটি স্থাপিত প্রায় দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ বছর আগে। তারপর ১৫ থেকে ১৬ শতকে এটি আরও বাড়ানো হয়। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন কৃষ্ণের পৌত্র বজ্রনাভ। কৃষ্ণের বাসভবনের ওপরই এটি নির্মাণ করেছিলেন তিনি।

একে বলা হয় ‘হরিগৃহ’। ১৪৭২ সালে মন্দিরের আসল আদলটি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন মাহমুদ বেগাদা। তারপরই ১৫ থেকে ১৬ শতকে আবার তা তৈরি করা হয় ও প্রসারিত হয়। তৈরি হয় চালুক্য স্থাপত্য কার্যের আদলে। এটি তৈরি হয়েছিল লাইমস্টোন দিয়ে। মন্দিরের দু’টি প্রবেশদ্বার আছে উত্তরের প্রবেশদ্বারকে বলা হয় ‘মোক্ষদ্বার’। দক্ষিণের প্রবেশদ্বারটি ‘স্বর্গদ্বার’ নামে পরিচিত। পাশেই রয়েছে গৌতমী নদী।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই মন্দিরগুলো সম্পর্কে জেনে আপনাদের কেমন লাগলো?

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!