বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সংক্ষিপ্ত জীবনী
বাঙালি হিন্দুদের কাছে একটি অতি আদরণীয় নাম লোকনাথ ব্রহ্মচারী। তিনি বাবা লোকনাথ নামে সর্বাধিক পরিচিত। বিশ্বাস করা হয় বাবা লোকনাথের আশীর্বাদ সাথে থাকলে কোন বিপদ কাছে ঘেঁষতে পারেনা। বাবা লোকনাথের বিখ্যাত বাণী “রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়বি, আমাকে স্মরণ করবি, আমিই রক্ষা করবো।”
তৎকালীন যশোহর জেলা আর বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসাত মহকুমার চৌরশী চাকলা নামক গ্রামে বাংলা ১১৩৭ সালে অর্থাৎ ১৭৩০ খ্রীষ্টাব্দে বাবা লোকনাথ জন্মগ্রহণ করেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বাবার নাম ছিল রামনারায়ণ ও মায়ের নাম ছিল কমলা দেবী। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ধার্মিক ব্রাহ্মণ।
আরো পড়ুনঃ নেপালের এই জায়গায় এখনো দেখা যায় ভগবান কৃষ্ণের পায়ের ছাপ!
বাবা লোকনাথ ছিলেন পিতামাতার চতুর্থ সন্তান। সেই সময়ে বিশ্বাস ছিল যে, কোন একটি পুত্রকে সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত করা হলে বংশ উদ্ধার হয়। লোকনাথের বাবা রামনারায়ণ তাঁর প্রথম সন্তান থেকেই প্রতিটি সন্তানকে সন্ন্যাসী বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু স্ত্রীর জন্য তিনি পেরে উঠেননি। তবে চতুর্থ সন্তান লোকনাথের ক্ষেত্রে রামনারায়ণ তা ঘটতে দেননি।
লোকনাথকে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করানোর জন্য তিনি এগারো বছর বয়সে বালক লোকনাথের উপনয়ন কার্য সমাপ্ত করে, পার্শ্ববর্তী গ্রামের সন্ন্যাসী ভগবান গাঙ্গুলীর হাতে লোকনাথকে সমর্পণ করেন। এসময় লোকনাথের সঙ্গী হোন তারই বাল্যবন্ধু বেণীমাধব।
ভগবান গাঙ্গুলী দুই শিষ্য লোকনাথ ও বেণীমাধবকে সাথে নিয়ে পদযাত্রা শুরু করেন। বিভিন্ন গ্রাম, শহর, নদী, বন অতিক্রম করে তারা প্রথমে কালীঘাটে এসে উপস্থিত হন এবং এখানে যোগ সাধনা শুরু করেন। গুরুর আদেশে বিভিন্ন যোগসাধনা ও ব্রত পালন করে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন।
ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পর শুরু হয় দেশ ভ্রমণ। বাবা লোকনাথ পশ্চিম দিকে দিয়ে আফগানিস্তান, মক্কা, মদিনা ইত্যাদি স্থান অতিক্রম করে আটলান্টিক মহাসাগর উপকূল পর্যন্ত গমন করেছিলেন। দিনে দিনে গুরুর বয়স একশত বছর ও শিষ্যদের বয়স পঞ্চাশ বছর হলো। গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলী শিষ্য দুজনকে শ্রী তৈলঙ্গস্বামীর হাতে তুলে দিয়ে পরলোক গমন করেন।
আরো পড়ুনঃ মৃত্যু শয্যায় মা যশোদা শ্রীকৃষ্ণের কাছে কোন আক্ষেপ রেখেছিলেন?
এরপর বেণীমাধবকে সঙ্গে নিয়ে বাবা লোকনাথ প্রথমে আফগানিস্তানের কাবুলে উপস্থিত হন। এখানে মোল্লা সাদী নামে এক মুসলিম ব্যক্তির সঙ্গে বেদ, কোরানসহ বিভিন্ন শাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেন। আরব দেশ ভ্রমণকালে মক্কাদেশীয় মুসলিম জনগোষ্ঠী তাঁকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করেন। সেখানে আব্দুল গফুর নামে এক বিদগ্ধ ব্যক্তির সাথে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর পরিচয় হয়।
এরপর তারা পারস্য, আরব, মক্কা-মদিনা, তুরস্ক, ইতালী, গ্রীস, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, চীনসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। তারপর তারা দুজনে চন্দ্রনাথে আগমণ করেন এবং এখানে কিছুকাল অবস্থান করে বেণীমাধব কামাখ্যায় ও বাবা লোকনাথ বারদীতে গমণ করেন। বারদীতে আসার পর থেকেই বাবা লোকনাথের মহিমা ও অলৌকিক গুণের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় থেকেই তিনি ‘বারদীর ব্রহ্মচারী’ হিসেবে পরিচিতি পান।
বারদীর জমিদার নাগ মহাশয় বাবা লোকনাথের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে মন্দির নির্মাণের জন্য জমি দান করেন। লোকনাথ বাবার আশ্রমের কথা শুনে বহু দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তগণ বারদীতে এসে ভীড় জমাতে থাকেন। এভাবেই বাবার আশীর্বাদপুষ্ঠ বারদী তীর্থভূমিতে পরিণত হয়।
বারদীতে অবস্থানকালেই ভাওয়ালের মহারাজ বাবা লোকনাথের একটি ছবি তুলেন। সেই ছবিরই প্রতিলিপি আজ আমাদের ঘরে ঘরে পূজিত হয়। বারদীতে অবস্থান কালে বাবা লোকনাথ অসংখ্য অলৌকিক মহিমা প্রদর্শন করেন।
আরো পড়ুনঃ বাবা লোকনাথের ১৫টি বাণী যা আপনার জীবন বদলে দিতে পারে নিমিষেই
এভাবেই একদিন চলে এলো বাবা লোকনাথের মহাপ্রয়াণের দিন। সেদিন ছিল বাংলা ১২৯৭ সালের ১৯ জ্যৈষ্ঠ, রবিবার (১ জুন, ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ)। বাবা লোকনাথ নিজেই তাঁর প্রয়াণের কথা জানিয়েছিলেন। এ কথা শুনে অশ্রুসজল চোখে অসংখ্য ভক্ত ছুটে আসেন আশ্রম প্রাঙ্গণে। আশ্রম মাতা বাবার জন্য শেষ বাল্যভোগ নিয়ে আসেন। বাল্যভোগ প্রসাদে পরিণত হওয়ার পর ভক্তগণ আনন্দচিত্তে সেই প্রসাদ গ্রহণ করেন। প্রসাদ গ্রহণ পর্ব শেষ হলে বাবা লোকনাথ মহাযোগে বসেন। আর এদিকে অশ্রুসজল চোখে ভক্তরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন, কখন বাবার মহাযোগ ভাঙবে! দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরও বাবার মহাযোগ না ভাঙতে দেখে মিনিটে তাঁর দেহ স্পর্শ করা হলে দেহ মাটিতে পড়ে যায়। এভাবেই ১৬০ বছর বয়সে লোকনাথ ব্রহ্মচারী দেহত্যাগ করেন।
ভক্তগণ উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে বাবার দেহ মন্দির থেকে তুলে এনে বিল্বতলে রাখেন। দেহ সৎকারের জন্য আনা হয় ঘি ও চন্দন কাঠ। বাবা লোকনাথের পূর্ব নির্দেশনা মোতাবেক, বাবার দেহ আশ্রমের পাশে চিতায় রেখে দাহকার্য সমাপ্ত হয়। এভাবেই বাবা লোকনাথ অনন্তলোকের পথে যাত্রা করেন। আর আমাদের জন্য রেখে গেলেন তাঁর পূণ্যস্মৃতি ও অসংখ্য অমরবাণী।
আরো পড়ুনঃ বাবা লোকনাথের একটি আশ্চর্য প্রতিকৃতি যার রহস্যের সমাধান আজও হয়নি