শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ইতিহাস
পাঁচ হাজার বছর আগের কথা। দ্বাপর যুগ। তখন বেশ কয়েকজন অসুর রাজা বিশ্ব শাসন করতো। অসুর রাজারা ছিলো খুবই অত্যাচারী। তাদের অত্যাচারে সকলেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দিন দিন অসুরদের অত্যাচার এতই বেশী হয়ে উঠে যে দেবদেবীগণ ক্ষীর সমুদ্র তীরে গিয়ে ভগবানের কৃপা প্রার্থনা করতে থাকেন।
তাদের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে শুধুমাত্র ব্রহ্মার অবগতির জন্য দৈববাণী হলো, “হে ব্রহ্মা, আমি খুব তাড়াতাড়ি যদুবংশীয় রাজাদের রাজধানী মথুরা রাজা সুরসেনের পুত্র বসুদেবের সন্তান রূপে দেবকীর অষ্টম গর্ভে আবির্ভূত হবো। ধরিত্রী দেবসহ তোমরা আমার নির্দেশ অনুসারে দ্বারকা, মথুরা এবং ব্রজের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জন্মগ্রহণ করবে।”
তখন উগ্রসেন নামে মথুরার এক রাজা ছিলেন। রাজা ছিলেন প্রচন্ড রকমের ধার্মিক। কিন্তু রাজা ধার্মিক থাকলে কি হবে, তার ছেলে কংস ছিল খুবই অত্যাচারী। কংসের অত্যাচারের মাত্রা এতটাই বেশী ছিল যে নিজের পিতা উগ্রসেনকেও সিংহাসনচ্যুত করে কারাবন্ধী করে নিজেই মথুরায় রাজত্ব করতো।
আবার এই কংসই আরাধনা করে বর লাভ করেছিল, তার বোন দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান ছাড়া অন্য কোন ভাবে তার মৃত্যু হবে না। আর এ জন্যই কংসের অত্যাচারের মাত্রাটাও এত বেশী ছিল।
দেবকীর বিবাহ হয় বসুদেবের সঙ্গে। রথের সারথী হয়ে কংস বর কণেকে রথের উপর বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। রথ চলছে এমন সময় হঠাৎ করে সেই দৈববাণীটি কংসের কানে বেজে উঠলো, “ওরে নির্বোধ যাকে তুমি রথে করে নিয়ে যাচ্ছো তার গর্ভের অষ্টম সন্তান তোমার প্রাণ হরণ করবে।”
দৈববাণী শুনে কংস সঙ্গে সঙ্গে খড়গ হাতে দেবকীকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হলো। এ দেখে বসুদেব কংসকে অনেক সবিনয় অনুরোধ করে রাজী করালেন এই বলে যে, তাদের প্রতিটি সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পরই কংসের হাতে তুলে দেয়া হবে। একথা শুনে কংস শান্ত হলো ঠিকই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেবকী ও বসুদেবকে কারাগারে নিক্ষেপ করলো।
মাঝখানে কেটে গেল অনেক বছর। একে একে জন্ম নিলো ছয়টি সন্তান। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর পরই কংস আসে এবং বসুদেব পূর্ব প্রতিশ্রতিমতো নিজ সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দেন। আর কংস সঙ্গে সঙ্গে পাথরের সাথে আছাড় দিয়ে সন্তানটিকে মেরে ফেলে। সপ্তম গর্ভের সন্তান বলরাম যখন অধিষ্ঠিত হয়েছিলন তখন ভগবানের নির্দেশে যোগমায়া দেবী দেবকীর গর্ভ হতে তাকে স্থানান্তরিত করে নন্দালয়ে রোহিনীর গর্ভে স্থাপন করেন এবং প্রচার করা হয় দেবকীর গর্ভপাত হয়েছে।
এবার অষ্টম গর্ভের সন্তান অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মগ্রহণ করার পালা। কারাগারের বাইরে পূর্বের চেয়ে কংস এবারও আরও বেশী পাহারার ব্যবস্থা করলো। মাস ছিলো ভাদ্র, তিথি ছিলো অষ্টমী এবং রজনী ছিলো ভীষণ দুর্যোগময়। প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে প্রকৃতি ধারণ করে এক অন্যরকম মূর্তি, বিদ্যুৎ উচ্ছ্বলিত ঠিক এমন সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবকীর গর্ভে আবির্ভূত হন এবং দৈববানী শোনা যায় “বসুদেব, তুমি এখনই গোকুলে গিয়ে নন্দের স্ত্রী যশোদার পাশে তোমার ছেলেটিকে রেখে এসো এবং এই মুহূর্তে তার যে কন্যা শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে তাকে এনে দেবকীর কোলে শুয়ে দাও। আমার মায়ায় পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এখন গভীর ঘুমে অচেতন, যার ফলে কেউ কিছুই জানতে পাবে না।”
সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে নিয়ে বসুদেব ছুটতে লাগলেন নন্দের বাড়ীর দিকে। পথে যমুনা নদী। বর্ষাকাল তাই যমুনা কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিলো। তখন বসুদেবের নিরুপায় মনে হলো। হঠাৎ করে বসুদেব দেখ্লেন যমুনার জল শুকিয়ে গিয়েছে এবং একটা শৃগাল যমুনা নদী পার হয়ে যাচ্ছে। বসুদেব তখন ঐ রূপধারী শৃগালকে পথ প্রদর্শক মনে করে তার পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগলেন। এমন সময় প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। বসুদেব ও শ্রীকৃষ্ণকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য নাগরাজ তার বিশাল ফণা বিস্তার কর্লেন তাদের মাথার উপরে। কিছু সময়ের মধ্যে বসুদেব তার ছেলেকে যশোদার কোলে রেখে যশোদার কন্যা যোগমায়াকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে এলেন।
সকাল বেলা কংস খবর পেল দেবকীর অষ্টম সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কারাগারে চলে এসে দেবকীর কোল থেকে মেয়েটিকে ছিনিয়ে নিয়ে একই ভাবে পাথরের উপরে আঁছাড় মারতেই মেয়েটি শূন্যে উঠে গিয়ে যোগমায়া মূর্তি ধারণ করে। মহাশূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার পূর্বে কংসকে বলে গেলো, “তোমাকে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে”।
এই কথা শুনে কংস মথুরার সকল শিশুকে মারার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। কংস শ্রীকৃষ্ণকে মারার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায় অবশেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসকে বধ করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।