মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য জীবনী, শিক্ষা ও লীলা কাহিনী
মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য জীবনী, শিক্ষা ও লীলা কাহিনী
১৪৮৬ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে এক ফাল্গুনী পূর্ণিমার সন্ধ্যায় বাংলার এক কোণে জন্ম নিলেন এক সুদর্শন বালক। নিম গাছের নিচে জন্মগ্রহণ করায় তাঁর নাম দেয়া হলো নিমাই। আমাদের আজকের আয়োজন সেই পরমাবতার নিমাই অর্থাৎ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্ম, শিক্ষা ও লীলা কাহিনী নিয়ে।
নিমাইয়ের পিতা জগন্নাথ মিশ্রের আদি বাড়ি ছিল তৎকালীন শ্রীহট্ট তথা অধুনা বাংলাদেশের সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ গ্রামে। নিমাই যখন মাতা শচীদেবীর গর্ভে তখন শচীদেবীর মায়ের স্বপ্নে পাওয়া আদেশ অনুযায়ী জগন্নাথ মিশ্র স্ত্রীকে নিয়ে নবদ্বীপে গমণ করেন। এখানেই ১৪৮৬ সালের এক দোল পূর্ণিমা তিথিতে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু।
শচী দেবী কয়েকজন কন্যা সন্তানের পাশাপাশি দুজন পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। পুত্রদ্বয়ের নাম শ্রী বিশ্বরূপ ও শ্রী বিশ্বম্ভর। শ্রীবিশ্বরূপ সন্ন্যাস গ্রহণের পর শচী জগন্নাথের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে রইলেন বিশ্বম্ভর, যার ডাক নাম নিমাই।
আরো পড়ুনঃ শ্রীকৃষ্ণের অভিশাপে আজও পৃথিবীতে বেঁচে আছেন অশ্বত্থামা, ঘুরে বেড়ান ভারতের নর্মদা নদীর তীরে
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ৪৮ বছর এই ধরাধামে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর জীবনের প্রথম ২৪ বছর তিনি নবদ্বীপে বাল্য ও গার্হস্থ্য লীলা এবং পরবর্তী ২৪ বছর জগন্নাথ পুরী, বৃন্দাবন সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে হরিনাম প্রচার ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী প্রচারে অতিবাহিত করেন। এই সময়কালে তিনি নিমাই থেকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নামে পরিচিত হতে থাকেন। তিনি কেবল গীতার বাণীই প্রচার করে থেমে থাকেননি। তিনি শ্রীমদ্ভাগবদগীতার মূল তত্ত্ব ও সারকথা ব্যবহারিকভাবে ভক্তদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এবার চলুন জেনে নিই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কয়েকটি ঐশী লীলার কথা
মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য লীলা ০১
একবার একটি চোর নিমাইয়ের গায়ের গহনা চুরি করার জন্য তাঁকে চুরি করে নিয়ে যায়। চোরটি নিমাইয়ের গায়ের গহনা ও অলঙ্কার খুলে নেয়ার জন্য একটি যুতসই ও নির্জন স্থান খুঁজছিল। নিমাই বেশ মজা করে সেই চোরের কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু ভগবানের মায়ার প্রভাবে সেই চোরটি গোলকধাঁধায় পড়ে আবার জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ির সামনেই এসে উপস্থিত হলো। হতভম্ব চোর তখন ধরা পড়ার ভয়ে নিমাইকে রেখেই পালিয়ে গেল।
মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য লীলা ০২
একবার এক তীর্থযাত্রী ব্রাহ্মণ জগন্নাথ মিশ্রের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। তিনি যখন ভগবানের উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করছিলেন তখন বালক নিমাই সেখানে উপস্থিত হয়ে সেই নৈবেদ্য খেতে শুরু করেন। ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ পুণরায় ভোগ বানিয়ে নৈবেদ্য নিবেদন করলেন। এবারও নিমাই সেই ভোগ আহার করতে লাগলেন। এভাবে পরপর তিনবার একই ঘটনা ঘটার পর নিমাইকে ঘরের মধ্যে শুইয়ে দেয়া হলো। গভীর রাত্রে সবাই যখন নিদ্রারত তখন সেই ব্রাহ্মণ বিশেষভাবে রান্না করা ভোগ ভগবানকে নিবেদন করলেন এবং ঠিক আগের মতো শিশু নিমাই সেই ভোগ নষ্ট করে দিলেন। দিশেহারা ব্রাহ্মণ তখন কাঁদতে শুরু করলেন। তখন শিশু নিমাই ব্রাহ্মণের নিকট নিজের স্বরূপ উদঘাটন করলেন। ব্রাহ্মণ দেখতে পেলেন সেই শিশুটি আসলে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। ব্রাহ্মণকে এই ঘটনাটি কাউকে না জানানোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে শিশু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মায়ের কোলে ফিরে গেলেন।
আরো পড়ুনঃ শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুলচন্দ্রের ৩০টি বাণী যা আপনার জীবনকে আরো সুন্দর করে তুলবে
মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য লীলা ০৩
একবার শ্রীনিবাসের বাড়িতে প্রবলভাবে সংকীর্তন হচ্ছিল। তখন মহাপ্রভু ভক্তদের জিজ্ঞাসা করলেন, তারা কী খেতে চান। ভক্তরা জানালেন তারা আম খেতে চান। তখন আমের মরসুম ছিলনা। তবু তিনি একটি আমের আটি চাইলেন। অতঃপর এক ভক্ত একটি আমের আটি তাঁকে এনে দিলেন। মহাপ্রভু সেই আমের আটিটি শ্রীনিবাস ঠাকুরের বাড়ির প্রাঙ্গণে পুঁতলেন। তৎক্ষণাৎ সেই আটি অঙ্কুরিত হয়ে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে লাগলো। নিমিষেই সেটি একটি পরিপূর্ণ বৃক্ষে পরিণত হলো এবং তাতে এতো পরিমাণে পাকা ও সুমিষ্ট আম ধরল যে ভক্তরা খেয়ে শেষ করতে পারলেন না। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর এই অপ্রাকৃত লীলা দেখে ভক্তবৃন্দ হরিধ্বনি দিতে লাগলেন। শ্রীনিবাস অঙ্গনে এখনো সেই গাছ বিদ্যমান।
মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য লীলা ০৪
চৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তি আন্দোলন তখন তুঙ্গে। দলে দলে লোকজন চৈতন্য মহাপ্রভুর ছায়াতলে এসে হরিনামে মগ্ন হচ্ছে। তখন কিছু গোঁড়া ও স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণ শ্রীচৈতন্য ও তাঁর ভক্তদের বিরুদ্ধে চাঁদ কাজীর কাছে নালিশ করেন। নবদ্বীপের মুসলিম কাজী এই অভিযোগে গুরুত্ব দিয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও তাঁর অনুগামীদের উচ্চস্বরে হরিনাম সংকীর্তন করতে নিষেধ করেন। কিন্তু চৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর অনুসারীদের এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে নির্দেশ দেন। কাজী তখন তাঁর পেয়াদা পাঠিয়ে সংকীর্তন বন্ধ করার চেষ্টা করেন। পেয়াদারা বেশ কয়েকটি মৃদঙ্গ ভেঙ্গে দেয়। এই ঘটনার কথা শুনে চৈতন্যদেব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে আরো বৃহৎ পরিসরে এই আইন অমান্যের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি হাজার হাজার মৃদঙ্গ ও করতাল সহযোগে লক্ষাধিক মানুষ নিয়ে এক বিরাট শোভাযাত্রার আয়োজন করেন। আইন অমান্য করে তিনি শোভাযাত্রা সহকারে কাজীর বাড়ির দিকে রওয়ানা হন।
আরো পড়ুনঃ জেনে নিন নিয়মিত ওম মন্ত্র পাঠে কি কি উপকার হয়
এতো মানুষের সমাগম দেখে কাজী ভয় পেয়ে বাড়ির ওপরতলার ঘরে আশ্রয় নেন। কাজীর বাড়ির সামনে উপস্থিত হয়ে ভক্তরা প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কিন্তু মহাপ্রভু তাঁদের শান্ত হতে বলেন। কাজী প্রথমে বাইরে আসতে না চাইলেও মহাপ্রভুর অভয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। এরপর উভয়ের মধ্যে হিন্দুশাস্ত্র ও কোরান নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সেই আলোচনায় শ্রীচৈতন্য গো হত্যার ভয়াবহ পরিণাম তুলে ধরেন।
“তোমরা জীয়াইতে নার-বধমাত্র সার। নরক হইতে তোমার নাহিক নিস্তার।। গো-অঙ্গে যত লোম, তত সহস্র বৎসর। গো-বধী রৌরব মধ্যে পচে নিরন্তর।।”
বিভিন্ন শাস্ত্রীয় যুক্তি তর্কের মাধ্যমে তিনি গোবধ ও সব ধরনের যজ্ঞ নিষিদ্ধ করালেন। হরিনাম সংকীর্তনকে কলিযুগের একমাত্র যজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তখন মুসলিম কাজী মহাপ্রভুর চরণে আশ্রয় নিলেন এবং ঘোষণা দিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তিত নাম সংকীর্তনে কখনও যেন কেউ বাধা না দেয়। এছাড়া তিনি তাঁর উইলে লিখে যান, তাঁর বংশের কেউ যদি কখনও নাম সংকীর্তনে বাধা দেয়, তাহলে তৎক্ষণাৎ সে বংশচ্যুত হবে। নবদ্বীপে মায়াপুরের সন্নিকটে এখনও শ্রীচাঁদ কাজীর সমাধি আছে।
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুই প্রথম ব্যক্তি যিনি সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতবর্ষে প্রথম আইন অমান্য করার সাহস দেখিয়েছিলেন।
আরো পড়ুনঃ কেরালার হাজার বছরের প্রাচীন মন্দির পাহারা দেয় নিরামিশাষী কুমির
মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য লীলা ০৫
সেকালে জগাই ও মাধাই নামে দুই ভাই ছিল। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণ, মদ্যপান, লুটপাট সহ এমন কোন কাজ ছিলনা, যা তারা করতোনা। তাঁদের যন্ত্রণায় সবাই অতিষ্ট ছিল। তাঁদের এই দুর্দশা দেখে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিষ্য নিত্যানন্দ প্রভু ও হরিদাস ঠাকুর তাঁদের হরিনাম করতে অনুরোধ করেন। হরিনামের অনুরোধ শুনে মাতাল দুই ভাই রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো এবং অশ্লীল গালাগাল দিয়ে তাদেরকে তাড়িয়ে দিল।
পরদিন আবার নিত্যানন্দ প্রভু ও হরিদাস ঠাকুর তাঁদের কাছে উপস্থিত হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতে বললেন। এ অনুরোধে ক্রুব্ধ মাধাই একটি কলসির কানা দিয়ে নিত্যানন্দ প্রভুর মাথায় আঘাত করল। নিত্যানন্দ প্রভুর কপাল ফেটে দরদর করে রক্ত পড়তে লাগলো। করুণাময় নিত্যানন্দ প্রভু এই কাজের জন্য কোন রকম প্রতিবাদ না করে বললেন, “মেরেছ কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেবোনা? তুমি যে আমাকে কলসির কানা ছুড়ে মেরেছ তাতে আমি কিছু মনে করিনি, কিন্তু আমার একমাত্র অনুরোধ যে তুমি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির নাম কীর্তন কর।
আরো পড়ুনঃ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সংক্ষিপ্ত জীবনী
প্রিয় শিষ্য নিত্যানন্দ প্রভুর আঘাতের খবর পেয়ে ক্ষুব্ধ মহাপ্রভু সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে সুদর্শন চক্র আহবান করলেন দুই পাপীকে সংহার করার জন্য। কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভু তাঁদের হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং মহাপ্রভুকে মর্ত্যলোকে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য মনে করিয়ে দিলেন। অতঃপর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জগাই-মাধাই দুই ভাইকে ক্ষমা করে দিলেন। এরপর জগাই-মাধাই সব পাপ কাজ ছেড়ে কৃষ্ণ ভাবনা ও হরিনাম সংকীর্তনে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও তাঁর প্রবর্তিত বৈষ্ণব মতবাদকে ঘিরে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য প্রাণ লাভ করেছিল। বাংলায় জন্ম নেওয়া শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আগমন এক বিশেষ শক্তি জুগিয়েছিল তৎকালীন হিন্দু সমাজকে।
শ্রীচৈতন্যের জীবনী শেয়ার করে অন্যকেও জানার সুযোগ করে দিন।