শ্রীকৃষ্ণ জীবনের সব থেকে বড় অন্যায় কোন কাজটি করেছিলেন?
শ্রীকৃষ্ণ পরম ভগবান হিসেবে আমাদের কাছে পূজিত। তাঁর জীবনের বিভিন্ন কর্ম ও উপদেশ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তথাপি মহাভারত ও ভাগবৎ পুরাণ গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শ্রীকৃষ্ণ এমন কিছু কাজ করেছিলেন যা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। শাস্ত্রবিদরা এসবকে তাঁর ঐশী লীলা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও মহাভারত বিশেষজ্ঞরা বারবার সরব হয়েছেন।
শ্রীরাধার সাথে গভীর প্রণয় থাকা সত্ত্বেও রাধাকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ না করায় অনেকে শ্রীকৃষ্ণের সমালোচনা করেন। তবে অনেক শাস্তবিদ মনে করেন, রাধার প্রতি কৃষ্ণের প্রেম বৈষ্ণব পরকীয়া তত্ত্বের আধার। তা আসলে প্রতীকী, এর মূল তাৎপর্য আধ্যাত্মিক। কাজেই রাধার প্রতি কৃষ্ণের এই আচরণ অন্যায় ছিলনা।
শ্রীকৃষ্ণের আরেকটি অনৈতিক কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয় জরাসন্ধ বধকে। জরাসন্ধ কৃষ্ণকে বারবার অপমান করতেন। এছাড়া জরাসন্ধের দম্ভকে চূর্ণ না করলে আর্যাবর্তের রাজনীতিতে জটিলতা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা ছিল। কৃষ্ণের পরামর্শে ভীম জরাসন্ধের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। সেই যুদ্ধে জরাসন্ধ পরাজিত হন এবং ভীম তাঁকে হত্যা করেন।
এছাড়া পৌণ্ড্র বাসুদেব নামে এক রাজাকে বধ করায়ও শ্রীকৃষ্ণের সমালোচনা করা হয়। পৌন্ড্র বাসুদেব সমন্ধে কৃষ্ণ বলেছেন, নিজেকে শ্রেষ্ঠ পুরুষ বলে পরিচয় দেয় এই দুরাচার। অজ্ঞানতা বশত: আমার শঙখ-চক্র-গদা ধারণ করেছে। সে বঙ্গ,পৌন্ড্র এবং কিরাত দেশের শাসক।
আরো পড়ুনঃ কৃষ্ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করার পরে শ্রীরাধার কী হয়েছিল? কৃষ্ণ কী রাধাকে বিয়ে করেছিলেন?
হরিবংশ পুরাণে আছে যে,পৌণ্ড্রশাসক বাসুদেব(কৃষ্ণের অপর নাম বাসুদেব) নাম ধারণ করায় এবং কৃষ্ণের ন্যায় শঙখ-চক্র-গদা ধারণকারী হওয়ায় কৃষ্ণ যুদ্ধে পৌন্ড্র বাসুদেব কে পরাজিত করেন এবং পৌন্ড্র বাসুদেব মৃত্যু বরণ করেন।
পঞ্চপান্ডবের পুত্র অর্থাৎ উপপান্ডবদের হত্যাকালে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে অনেকেই অন্যায় বলে চিহ্নিত করেছেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক আগের রাতে দ্রোণাচার্য পুত্র অশ্বত্থামা দ্রোপদীর পাঁচ পুত্রকে নিদ্রিত অবস্থায় হত্যা করেন। ত্রিকালজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণ এই ঘটনার কথা জানতেন না, এমনটা স্বপ্নেও ভাবা যায়না। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় তিনি কেন তাঁর প্রিয় সখী দ্রোপদীর সন্তানদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসেননি। ঘোর কৃষ্ণভক্তরাও এই প্রশ্নের জবাবে নিশ্চুপ হয়ে যান।
তবে এই বিষয়ে অনেকে অনেক মতবাদ ব্যক্ত করেন। তাঁর মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যাক-
দ্বৈপায়ন হৃদে উরুভঙ্গ অবস্থায় অবস্থান করছিলেন দুর্যোধন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন পান্ডবদের মৃত্যুসংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত তিনি দেহত্যাগ করবেন না। এখানে উল্লেখ্য যে অশ্বত্থামা পাণ্ডব ভেবেই উপপাণ্ডবদের হত্যা করেছিলেন। আর সেই সংবাদ শুনেই দুর্যোধন প্রাণ ত্যাগ করেছিলেন। দুর্যোধনের মৃত্যু পাণ্ডবদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই শ্রীকৃষ্ণ এই ঘটনায় বাঁধা দিতে পারেননি।
আরেকটি মতে, দ্রোণাচার্য পুত্র অশ্বত্থামা শিবের অবতার। নিজ অভিষ্ট কাজে সিদ্ধিলাভের জন্য তিনি মহাদেবের কাছে বর প্রার্থনা করেন। শিব তাঁকে জয়ের জন্য এক দৈব খড়্গ দান করেন। ত্রিকালজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণ জানতেন দৈবশক্তিতে বলীয়ান অশ্বত্থামা সে রাতের মতো অপরাজেয়। সব কিছু জেনেও তাই তিনি নীরব থাকেন।
আরো পড়ুনঃ মৃত্যু শয্যায় মা যশোদা শ্রীকৃষ্ণের কাছে কোন আক্ষেপ রেখেছিলেন?
আরেকটি মতে, শ্রীকৃষ্ণ ত্রিকালজ্ঞ। উপপাণ্ডবদের মৃত্যু অজানা না হলেও অনিবারণীয় বলেও মনে হয়নি। মহাভারতে নিয়তিবাদ সর্বপ্রধান ভূমিকায় আবির্ভূত। মহাভারত রচয়িত ব্যাসদেব কৌরবদের অনিবার্য ধ্বংস দেখাতে গিয়ে হয়তো ভেবেছেন কুন্তি বা গান্ধারীই কেন একা পুত্রশোক ভোগ করবেন! নিয়তি থেকে যে কারো নিস্তার নেই সেটি বুঝাতেই হয়তো উপপাণ্ডবদের মৃত্যু প্রদানের মাধ্যমে দ্রোপদীকেও পুত্র শোক প্রদান করেছেন।